উত্তর সম্পাদকীয়

উফ, কী গরম ও বর্ষার ভবিষ্যৎ

  • দেবদূত ঘোষঠাকুর

কর্মসূত্রে প্রতিদিন গড়িয়া থেকে নদিয়ার হরিণঘাটা যেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক করা বাসে। বাম দিকের জানালায় কে বসবেন, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় রীতিমতো। বৃহস্পতিবার দেখলাম অন্য চিত্র। বাম দিকের জানালা ছেড়ে বসার ধুম। অনুরোধ করলেও কেউ বসছেন না।

একেবারে প্রথমে উঠি বলে বাম দিকের আসন আমার বাঁধা। বৃহস্পতিবার সকাল ন’টাতেই বুঝলাম আজ কপালে কষ্ট আছে। যে বাতাস খোলা প্রশস্ত জানলা দিয়ে ঢুকে নাকে মুখে আছড়ে পড়ছে তাতে স্বস্তির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বাস মধ্যমগ্রাম এসে পৌঁছাতেই জানলা ছেড়ে পাশের আসনে সরে গেলাম। অনুষ্ঠান বাড়ির জ্বলন্ত কাঠের উনুন থেকে যেরকম তাপ বেরোয় তার থেকে কোনও অংশে কম জ্বালা ধরাচ্ছে না জানলা দিয়ে ঢোকা বাতাস।

ভাবছিলাম আমডাঙা পেরোলে দু’ধারে সবুজ খেত। তাই বাতাসের দহনজ্বালা কিছুটা কমবে। কিন্তু দেখলাম ক্রমেই পরিস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে।

আবহাওয়া, ক্লাইমেট চেঞ্জ, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে টুকটাক লেখালেখি করেছি এক সময়। তাই আবহাওয়ার চরিত্র এবং তা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদক ভালোভাবেই পরিচিত। শীত কিংবা গরমে এক-দু’দিন তাপমাত্রা কিছুটা কমলে বা বাড়লেই মানুষ বলতে থাকেন, ‘এত শীত আগে কখনও দেখিনি’ কিংবা ‘এমন গরম আগে কখনও কেউ দেখেনি।’  আবহবিদরাও মানুষের এই ধরনের প্রতিক্রিয়াকে খুব একটা আমল দিতেন না।

এক প্রবীণ আবহবিজ্ঞানীর কাছে মাঝে মাঝে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করে ধমক খেয়েছি, ‘এখন মানুষের অল্প কষ্ট সহ্য হয় না। বাড়িতে-অফিসে এসি, ওয়াটার কুলার, শীতকালে রুম হিটার। তাই একটু এদিক ওদিক হলেই গেল গেল রব ওঠে।’ গতবার এই সময়টা তাপপ্রবাহের মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় এক আবহবিদকে শুধু বলেছিলাম, ‘এবার মনে হয় পরিস্থিতি আলাদা।’ প্রবীণ ওই আবহবিদ কপালের উপরে চশমাটা তুলে বলেছিলেন, ‘আপনাদের মানসিক ছন্দ নষ্ট হলেও, আবহাওয়ার ছন্দ মোটামুটি একই আছে। একটু এদিক ওদিক হতে পারে। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।’ ওঁর এক সহকর্মীর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এই বুঝি বলে বসেন, ‘সমস্যাটা আপনার। আবহাওয়ার নয়!’

বৃহস্পতিবার বাসে সফর করতে করতে ভাবছিলাম, উপরের ওই প্রতিক্রিয়াটি যদি আজ পাই ভালো হয়। তাঁর আগে একবার অতীতের পরিসংখ্যানগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। চোখ আটকে গেল ঘূর্ণিঝড় আয়লা’র বছরে, ২০০৯ সালের পরিসংখ্যানে। সেবার আয়লার দাপটে বর্ষা আগেভাগে চলে এলেও, শেষপর্যন্ত ২৯ শতাংশের ঘাটতি রেখেই বিদায় নেয় মৌসুমি বায়ু। সেবার এপ্রিলের এই সময়টায় (১৮-২৭ ) ৮ দিন কলকাতার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

এর পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৪ সালে।‌ ২২ থেকে ২৬ এপ্রিল, টানা ৫ দিন কলকাতা ছিল চল্লিশ ডিগ্রির ঘরে।  ২০১৬-তে ৮ থেকে ১৬ এপ্রিল, ৯ দিনের মধ্যে ৬ দিনই ৪০ ডিগ্রির উপরে ছিল তাপমাত্রা। গত বছরেও তাই।

১৪ থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে ৫ দিন কলকাতার তাপমাত্রা কিন্তু চল্লিশের উপরে ছিল। অর্থাৎ এতদিন ধরে কলকাতায় তাপপ্রবাহের মতো পরিস্থিতি যে শুধু এবারেই তৈরি হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না। তবে এবার বাসে বাতাসের বদলে যে আগুনের ছোঁয়া অনুভব করলাম, তা কলকাতা ও আশপাশে আগে কখনও কি অনুভব করেছি? আবহাওয়া দপ্তরের পরিসংখ্যানেও তার হদিস পাচ্ছি না।

বিভিন্ন নম্বরে ফোন করতে করতে পেয়ে গেলাম আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর

জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথকে। তাপপ্রবাহের মতো এই পরিস্থিতির সঙ্গে এ রাজ্যের পরিচয় যে আগেই হয়েছে তা অস্বীকার না করলেও, এবারের গরম যে একেবারে অন্যরকম, এমন মন্তব্য করে বসলেন গোকুলবাবু। কীভাবে? তাঁর মতে, এবারের গরমের চরিত্রটাই অন্যবারের থেকে অনেকটাই আলাদা। অন্যবারের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। সেজন্যই আকাশে যেমন মেঘ নেই, পাশাপাশি হাওয়ায় নেই এতটুকুও সোঁদা গন্ধ। আমাদের এখানকার পরিচিত জলীয় বাষ্প মাখা বাতাসের পরিবর্তে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো শুকনো গরম বাতাস!

কেন এই অবস্থা? এতদিন বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না পেলেও, এবারের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি যে আবহবিদদের রীতিমতো ভাবাচ্ছে তা গোকুলবাবুর কথাতেই পরিষ্কার। এ বছরটা ‘এল নিনো’-র বছর। অর্থাৎ এবার সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বছর। এল নিনো ঘুরেফিরে আসে। কিন্তু তার এমন প্রভাব আগে এতটা তীব্র হতে দেখা যায়নি বলে মনে করেন আবহবিদদের অনেকেই। আবহবিদের অনেকের মতেই, এল নিনো এবার পশ্চিমী ঝঞ্ঝার চরিত্র বদলে দিয়েছে।

গোকুলবাবু বলেন, শীতকালটা পশ্চিমী ঝঞ্ঝার সময়।

ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ওই ঝঞ্ঝা কাশ্মীর দিয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা কাশ্মীর থেকে উত্তর ভারত হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার হাত ধরেই আসে তুষারপাত, শীত। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার বিদায় মানেই তুষারপাত, শীতের বিদায়। কিন্তু এবার সেই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা পুরোপুরি বিদায় নেওয়ার আগে ফের নতুন ঝঞ্ঝা এসে হানা দিয়েছে। মরুদেশে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে তার জেরে অসময়ে প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবন হয়ে গিয়েছে। আর তার সেই পশ্চিমী ঝঞ্ঝাই এ দেশের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সব জলীয় বাষ্প। উপকূলবর্তী গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বাতাস এখন তাই শুকনো হয়ে গিয়েছে। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে বাতাসের তাপমাত্রা। ক্রমেই অসহনীয় হয়ে পড়ছে তা।

কবে যে এই পরিস্থিতি কেটে গিয়ে বাতাসে জলীয় বাষ্প ঢুকবে তার পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে না। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা দুর্বল হলেই একমাত্র পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।‌ তবে গোকুলবাবুর মতো আবহবিদদের মূল আশঙ্কা বর্ষাকে নিয়ে। কারণ, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা থাকা মানে হিমালয় পাদদেশে কম বৃষ্টি হওয়া। আর হিমালয়ের পাদদেশে কম বৃষ্টির অর্থ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশাতে এবার অনাবৃষ্টির হাতছানি। পূর্ব ভারত বৃষ্টি তেমন না পেলেও এই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা পশ্চিম ভারতের বৃষ্টি বাড়াবে। সেখানে আবার প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দেবে।

অর্থাৎ আরও কষ্টের দিন কিন্তু সামনে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আবহবিদের আশঙ্কা আমরা কেমন যেন হালকাভাবে নিয়ে থাকি। হাসিতামাশা করি। বিশ্ব উষ্ণায়ন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার সময় কিন্তু এসে গিয়েছে।‌ আকাশে বিষাক্ত গ্যাস পাঠিয়ে আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি বাতাসের ঘনত্ব। সেই ভারী বাতাস নেমে আসছে নীচে। মেঘ তৈরির পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। ২০২৩ ছিল উষ্ণতম বছর। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন গত বছর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘২০২৪ সালে এল নিনো’র প্রভাব আরও বাড়বে।

অর্থাৎ ২০২৪ হতে পারে উষ্ণতম বছর। তাঁর আশঙ্কা ছিল সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। তার ফলই কি দেখছি আমরা? এবার কিন্তু বিপদ ঘরে চলে এসেছে। আর কবে সতর্ক হব আমরা?

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Money Seized | ফের উদ্ধার টাকার পাহাড়! আয়কর দপ্তরের নিশানায় এবার কারা?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এ যেন টাকার পাহাড়! তিন জুতো ব্যবসায়ীর (Show traders) বাড়িতে তল্লাশি…

12 mins ago

Narendra Modi | ‘সন্তদের অপমান দেশ মেনে নেবে না’, মমতার মন্তব্যের কড়া জবাব মোদির

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন এবং ইসকনের সন্তদের অপমান দেশ মেনে…

14 mins ago

পায়ের ব্যথা ভোগাচ্ছে? নিয়ম করে এই ৩টি ব্যায়াম করুন…

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অল্প বয়স থেকেই পায়ের ব্যথায় ভুগছেন? ২৫-এর তরুণী হোক বা পঞ্চাশোর্ধ্ব…

31 mins ago

Siliguri | মহানন্দা সেতুর নীচে মদ-জুয়ার আসর, ক্ষোভ বাসিন্দাদের

শিলিগুড়ি: পুলিশের নাকের ডগায় বসেছে জুয়ার আসর। শিলিগুড়ির(Siliguri) এয়ারভিউ মোড় সংলগ্ন মহানন্দা সেতুর(Mahananda Bridge) নীচেই…

1 hour ago

Siliguri | বৃষ্টিতে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা, নজরদারি বাড়াচ্ছে পুরনিগম

রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি: বৃষ্টি নিয়ে দোলাচলে শিলিগুড়ি (Siliguri) পুরনিগমের দুই দপ্তর। জল সংকটের মাঝে বৃষ্টিতে…

1 hour ago

COVID-19 | ফের থাবা করোনার! সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত প্রায় ২৬ হাজার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সিঙ্গাপুরে (Singapore) নতুন করে থাবা বসাল করোনা ভাইরাস (COVID-19)। করোনার নতুন…

1 hour ago

This website uses cookies.