- কুণাল সেন
বাবার সবচেয়ে বড় সমালোচক যদি বলতে হয়, তাহলে সেই শিরোপা আমার প্রাপ্য। আমার তখন খুব অল্প বয়স। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই বাবা তাঁর ছবির চিত্রনাট্য মা আর আমাকে রোজ শোনাতেন। একেবারে স্ক্রিপ্ট পড়েই শোনাতেন। আমার কাজ ছিল খুঁত বের করা, যাকে বলে ছিদ্রাণ্বেষী। এই নিয়ে মতের অমিল হত দুজনের মধ্যে, কিন্তু তাও ছিল খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটা ধাপে আমরা একে-অপরকে চ্যালেঞ্জ করেছি। যেমনটা অনেক সময় হয় বন্ধুদের মধ্যে। বাবার সঙ্গে আমার অসমবয়সি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেই বন্ধুত্বে বাবার প্রতি ছেলের নিয়মমাফিক আনুগত্য দেখানোর কোনও বিষয় ছিল না। বাবাকে তো আমি ‘বন্ধু’ নামেই ডাকতাম। এটা এখন অনেকে জানে। এই বিষয়ে লিখেওছি আমার স্মৃতিকথামূলক বই ‘বন্ধু- মাই ফাদার, মাই ফ্রেন্ড’।
আসলে, বাবাকে যে কখন ‘বন্ধু’ নামে ডাকতে শুরু করেছি সে কথা আজ আর মনে নেই। সত্যি বলতে, বাবাকে ‘বন্ধু’ নামে ডাকাটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। বাংলায় ‘বন্ধু’ বলতে ‘ইয়ার’ বা ‘দোস্ত’কেই সাধারণত বোঝানো হয়। ‘বন্ধু’ ডাকার একটা কারণ হতে পারে যে, আমার সঙ্গে খেলতে খেলতে তিনি একবার বোধকরি বলেছিলেন, ‘আমরা দুজনে বন্ধু’। সেই শব্দটি আমার মনকে আকৃষ্ট করে। কার্যকারণ যাই হোক না কেন, বাবাকে আমি কেবল ‘বন্ধু’ নামেই ডাকতাম।
ছোটবেলায় এতে অবশ্য তেমন সমস্যা দেখা দেয়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ওই নামে ডাকা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। বলা ভালো, আত্ম-সচেতন হতে থাকি। কিন্তু তারপরও কেন বাবার মতো সর্বজনগ্রাহ্য নামে তাঁকে ডাকা শুরু করিনি সেই কারণটা আমার জানা নেই। তখন আমার আট বা নয় বছর বয়স। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ি। আর সকলের সঙ্গে স্কুলবাসেই যাতায়াত করতাম।
একদিন কোনও কারণে বাবা আমাকে স্কুলে আনতে গেলেন। ছুটির আগে স্কুল থেকে যাওয়ার জন্য অনুমতির প্রয়োজন। অনুমতি নেওয়ার জন্য স্কুলের নির্দিষ্ট দপ্তরে গেলাম। কেউ আমাকে নিতে এসেছে কি না জানতে চাওয়া হল। বললাম, ‘হ্যাঁ’। তার ঠিক পরের প্রশ্ন, ‘কে নিতে এসেছেন?’ মুশকিলে পড়লাম। বাবাকে আমি ‘বন্ধু’ নামে ডাকি সে কথা বলতে পারছি না। অন্যদিকে ‘বাবা’ ডাকাটা আরও কষ্টকর। সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত বললাম, ‘একজন লোক’। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। এতেই কাজ হল। দপ্তর থেকে আমাকে আগে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল।
সৌভাগ্যই বলতে হবে, ছোটবেলায় আমার বন্ধু-বান্ধবদের সামনে বাবাকে প্রায় ডাকতেই হত না। আর অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার সময় তাঁকে ‘বাবা’ হিসেবেই উল্লেখ করতাম। কাজেই আমার গোপন কথাটি ভালোভাবে গোপনই থেকে গিয়েছিল। অবশ্য বছর দশেক বয়সে একটা ঘটনা ঘটেই গেল। ঘটনাটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। সরস্বতীপুজোর পরে-পরে বহু প্রতিমাকে বিসর্জনের জন্য সন্ধ্যায় নদীপাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বিসর্জন দেখার জন্য বাবা আমাকে সহ আমাদের বন্ধুদের নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। সে সময় তাঁর একটি সিনেমার শুটিং চলছিল। প্রোডাকশন দলের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। তাতে আমাদের সবাই এঁটে যাব। সত্যি বলতে, এর আগে আমরা কেউ বিসর্জনের দৃশ্য দেখিনি। তাই সবাই বেশ কৌতূহলী ছিলাম। একে একে সবাই গাড়ির ভেতরে জানলার ধার ঘেঁষে বেঞ্চে বসে পড়লাম। যাত্রা শুরু হল।
আমরা কল্পনায় যা ভেবেছিলাম, বিসর্জনের আনন্দ তার চেয়েও ঢের বেশি বলে মনে হয়েছিল। যাকে বলে একেবারে রোমাঞ্চকর। আমাদের প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেল সেদিনের ঘটনা। শয়ে-শয়ে সরস্বতীমূর্তিকে জলে ফেলা হচ্ছে। কাঠামোগুলো ভেসে চলেছে জলের টানে। বিসর্জন শেষ হল। বাবা, মেট্রো সিনেমার পাশে একটা সরু গলিতে আমাদের নিয়ে গেলেন। এক জায়গায় কুলফি বিক্রি হচ্ছিল। বাবা আমাদের সবাইকে কুলফি কিনে দিলেন। একজন আইসক্রিমগুলো আমাদের জন্য নিয়ে এলেন। দাম মেটানোর জন্য বাবা গাড়ি থেকে নামলেন। তিনি না ফেরা পর্যন্ত গাড়ি থেকে কাউকে নামতে মানা করে গেলেন।
এর মধ্যে আমাদের এক বন্ধুর খুব জোর পিপাসা পেল। যেভাবেই হোক জলের দরকার। স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে চাপল। এবারে আমি পড়লাম মুশকিলে। গাড়ি থেকে বাবা তখন বেশ খানিকটা দূরে। কুলফির দোকানের সামনে। গাড়ি থেকে নামতে মানা করে গেছেন। আমার কচি-কাঁচা মাথায় চিন্তার ঢেউ খেলতে লাগল। সম্বোধনের গোপন কথাটি গোপন রেখে কী করে বাবার নজর টানা যায় সেই চিন্তা করতে লাগলাম। শেষে ‘মৃণালদা’ বলে হাঁক ছাড়লাম। এভাবে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে বড় ভাইদের ডাকা হয়, বাবাকে কোনও ভাবেই নয়। এই ডাক আমাদের বন্ধুদের কাছে কতটা অদ্ভুত শোনাতে পারে সে কথা একবারও মাথায় আসেনি।
তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভয় বা লজ্জা কেটে গেল। আলাদাভাবে বাবাকে লোকজনের সামনে ‘বন্ধু’ নামে ডাকতে ইতস্তত করতাম না। হাইস্কুলে পড়ার সময় প্রথম সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ দেখি। চলচ্চিত্রটির শেষের দিকে অপু অর্থাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শেষপর্যন্ত তাঁর ছোট্ট ছেলে কাজলের সাক্ষাৎ হয়। ছেলেটি প্রশ্ন করে, ‘তুমি কে?’ দাড়ি-গোঁফওয়ালা অপু জবাব দেয়, ‘তোমার বন্ধু’। কথাটি খুবই সুন্দরভাবে আমার বেলায় লাগসই হয়েছে।
একসময় কলেজে পা রাখলাম। স্বাভাবিকভাবে আমার বন্ধুমহলের পরিধি বাড়ল। আমার বন্ধু-বান্ধবরা দিনের অনেকটা সময়ই আমাদের বাড়িতে কাটাত। বাবা তাদেরকে ‘মৃণালদা’ ডাকতে উৎসাহিত করতেন। কাকা বা জেঠু ডাকাটা মোটেও পছন্দ করতেন না। এভাবেই আমার সব বন্ধু-বান্ধব এবং জগৎজুড়ে তাঁর পরিচিত মহল তাঁকে ‘মৃণালদা’ ডাকতে শুরু করেন। নিশা, আমার বান্ধবী, যাকে আমি পরে বিয়ে করি এবং বোন জাগৃতি সহ আমাদের কয়েকজন বান্ধবীও বাবাকে ‘বন্ধু’ নামেই ডাকত। আমরা স্কুলজীবনের বন্ধু, তাই বাবাকে কোনও বিশেষ নামে ডাকা নিশার জন্য কোনও দরকার ছিল না। এমনকি, আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরুর পরও নিশা তার শ্বশুরমশাইকে ‘বন্ধু’ বলেই ডাকত।
বাবা যে কতটা সংবেদনশীল এবং সৎ মানুষ ছিলেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে সাংসারিক বিষয়ে বেশ উদাসীন ছিলেন। মা গীতা সেনই সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। মাকে এই নিয়ে সেভাবে কখনও দোষারোপ করতে দেখিনি, শুনিনি। দুজনের মধ্যে আজীবন অসম্ভব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। এমনও হয়েছে, মা উনুন জ্বালিয়ে হাঁড়িতে জল দিয়ে অপেক্ষা করছেন, বাবা চাল নিয়ে ফিরবেন। মিনিট যায়, ঘণ্টা যায় বাবার কোনও হদিস পাওয়া যায় না। শেষমেশ খোঁজ নিয়ে হয়তো জানা গেল, তিনি কাছের কোনও পার্কে বসে আড্ডা মারছেন।
আরেকটা ঘটনা বলি। একবার মাঠে খেলতে গিয়েছি। চোট-আঘাতে আমার থুতনি গেল ফেটে। আমার সহ খেলুড়েরা, বিশেষ করে যারা আমার থেকে বয়সে বড়, তারা আমাকে নিয়ে গেল পাড়ার এক ওষুধের দোকানে। নিয়ে গিয়ে স্টিচ করে আনল। আমার থুতনি ফেটে গিয়েছে দেখে মা তো বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসলেন। চোটের ধকলে আমার হালকা জ্বরও এসেছিল। বাবা ফিরে এসে সব শুনলেন। আমার বগলে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপতে মাপতে শুরু করলেন তাঁর সম্প্রতি শেষ হওয়া ট্যুরের গল্প। মা তো হাঁ। রাগবেন, নাকি বকবেন!
বাবা নিজে সিনেমা তৈরি করতেন ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে সেভাবে কোনও আড়ম্বর পছন্দ ছিল না। খুব অল্প খরচে সিনেমা তৈরি করতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। কম বাজেটে সিনেমা তৈরির বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেও কখনো-কখনো নিয়েছিলেন। একেবারে ভিন্ন ধারার ছবি যে বানাতেন, সে তো আমরা জানি। বাংলা ছবির পাশাপাশি তৈরি করেছিলেন হিন্দি, তেলুগু, ওডিয়া ভাষায় ছবি। ছবিতে গানের ব্যবহার যেটুকু না করলেই নয়, তা-ই করতেন। কলকাতার প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ টান। সেই ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি তাঁর ছবিতে ভীষণভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাবা দূরদর্শনের জন্য প্রায় ডজনখানেক যেসব শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিলেন, সে সবই হারিয়ে গিয়েছে। তবে ছোটপর্দার প্রতি তাঁর প্রথমদিকে একেবারেই ঝোঁক ছিল না। টেলিভিশনে ছবির মাঝে যে কমার্সিয়াল চলত, তা নিয়ে বাবার আপত্তি ছিল ভীষণ। তীব্র নিন্দা করতেন। এই কারণে প্রথমে তিনি দূরদর্শনের ছবি করতে রাজি হননি। পরে শর্ট ফিল্ম বানাতে শর্ত দিয়েছিলেন, ছবির প্রথমে এবং শেষে বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে, মাঝে একেবারেই নয়। যাই হোক, সেইসব শর্ট ফিল্ম পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেও তা আর সম্ভব হয়নি।
সেবার বাবা-র ‘কলকাতা ৭১’ মুক্তি পেয়েছে কলকাতার এক সিনেমা হলে। বন্ধুরা সবাই মিলে দেখতে যাব বলে ঠিক করেছি। সকাল থেকে, বিশাল লম্বা লাইন হলের সামনে। ঠায় দাঁড়িয়ে সবাই। আমিও দাঁড়িয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে। হঠাৎ আমায় দেখতে পেলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার। তিনি এসে আমাকে লাইন থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইলেন। লাইনে ঘণ্টাকয়েক দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের দিকে তাকাতেই আমার তখন ভীষণ অস্বস্তি হতে শুরু করল। কারণ, আমি তো সিস্টেমের বাইরে নই! বাবার পরিচয় দিয়ে কিছু করতে আমি কখনোই চাইনি, বাবাও কোনওদিন প্রশ্রয় দেননি। এ আমার সৌভাগ্য।
সাক্ষাৎকার, অনুবাদ, সংকলন : সৈয়দ মূসা রেজা