- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ভোরবেলা বেরোলে শহরের অনেক পাড়ায় কীর্তনের দলকে দেখা যায় এখনও। লোক অল্প, বেশি আবেগ। খোলকত্তাল নিয়ে যে গান তাঁরা গেয়ে চলেন, তা শুনে বৃহস্পতিবার হঠাৎ মনে পড়ল গোপাল ভাঁড়ের পরিচিত গল্প। কীর্তনিয়াদের কোনও দোষ নেই। গোপাল কাহিনী মাথায় এল জমি মাফিয়াদের দুর্নীতির রথযাত্রা দেখে।
অনেক রূপ রয়েছে গল্পটার। অতি সংক্ষেপে যে কোনও একটা বলে দিই। কৃষ্ণনগরে এক স্যাকরা ছিলেন। তাঁর কর্মচারীর নাম হরিহর। বোকা ক্রেতা দেখলেই মালিক চ্যাঁচাতেন, ‘হরি হর, হর হর।’ আপাতভাবে হরিভজনা মনে হবে। আসলে তিনি বলতেন, হরিহর, হরণ কর। একবার বললে একটু কম চুরি করো। দু’বার বললে বেশি।
তা সদ্য জেলবন্দি দেবাশিস প্রামাণিকের মতো অনেক তৃণমূল নেতার এভাবে তৃণমূল স্তরে লোকের সম্পদ হরণের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। লোকে বুঝতে পারবে না, পরে হঠাৎ উপলদ্ধি করবে, জলের দরে তাঁর জমিটি ভ্যানিশ রাতারাতি। দাদাদের আশিসে দেবাশিসদের নয়া গান, ‘জমি কার, জোর যার/ হরি হরি? হর হর!’
এমনিতে উত্তরবঙ্গ ফেল, শুনলে আমাদের সবার, আটটি জেলার অজস্র মানুষের জ্বলে ওঠার কথা। সমস্বরে প্রতিবাদী হব আমরা। এই প্রথম বোধহয় উত্তরবঙ্গকে ফেল দেখে উত্তরবঙ্গের মানুষের আনন্দ হল। পুরসভা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত ভর্ৎসনার পর প্রকাশিত রিপোর্ট কার্ডে উত্তরবঙ্গীয় শহরগুলোর শোচনীয় রেজাল্ট দেখে।
এই আনন্দের কারণটা কী? এতদিনে চরম সত্যগুলো প্রশাসনের মাথা পর্যন্ত পৌঁছেছে। বলছেন, তাঁরা বলছেন। বলছেন তোলাবাজির কথা। লোভের কথা। বালি-পাথর-কয়লা পাচারের কথা। জমি ভ্যানিশ করার কথা। জল, জঞ্জাল, বিদ্যুৎ, বেআইনি নির্মাণ নিয়ে মানুষের মনের সব কথা। রাস্তাজুড়ে বেআইনি দোকান বসানের কথা।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এই বোধোদয় এত দেরিতে কেন দিদি? আপনি কি আপনার ভাইদের লোভ, তোলাবাজির কথা জানতেন না এতদিন? যদি না জানেন, সেটা কি আপনার প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তো কবে থেকে কিছু প্রচারপ্রিয় মন্ত্রী ও নেতার বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন। ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরে বেমক্কা কালীঘাট বনাম ক্যামাক স্ট্রিটে পরিণত হয়ে গেল কেন?
হে পাঠক, আপনার প্রশ্নগুলো অত্যন্ত ন্যায্য। স্নেহের ভাইদের অসততার চক্রব্যূহে দিদি অতিবিরক্ত। অথচ তাঁর কিছু করার নেই। ঠগ বাছতে গাঁ সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তবু ভালো, ঠিক সময়ে প্রশ্নটা তুলেছেন তিনি।
এখানে এই প্রশ্নমালাকে শুধু আরও একটু ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের শহরগুলোর প্রশাসন যদি এত ব্যর্থই হয়, কেন শহরের মাথাদের সরিয়ে দিলেন না মমতা?
উত্তর একটাই। উত্তরবঙ্গে কোনও শহরে বা জেলায় রাজনীতিতে কোনও বিকল্প মুখ নেই এখন। না দিদির দলে, না দিদির কোনও বিরোধী দলে। মমতার নিজের দলে যেমন দ্রুত অভিষেকের মতো পরিবর্ত মুখ উঠে এসেছে, অন্য কোথাও তার ছাপ নেই।
শিলিগুড়ির রাস্তায় গত ক’দিনে কয়েকজন অচেনা লোককে প্রশ্ন করলাম, গৌতম দেব মেয়র হিসেবে কতটা সফল। আটানব্বই ভাগ লোক বললেন, একেবারে সফল নন। দুর্নীতি, ঔদ্ধত্য- দুটোই সরাতে ব্যর্থ। অথচ যখনই প্রশ্ন হল, গৌতমের বিকল্প কে বলুন? উত্তরদাতা অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, আর কাউকে তো পাওয়া যাচ্ছে না।
মমতা যে নাগরিক চেতনার কথা ভেবে সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন, সেই নাগরিকদেরই প্রশ্ন করলে মালদার কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী, জলপাইগুড়ির সৈকত চট্টোপাধ্যায়, কোচবিহারের রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, আলিপুরদুয়ারের প্রসেনজিৎ কর, রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী সম্পর্কে একরাশ হতাশা জানাবেন। যা গৌতম দেব প্রসঙ্গে শোনা যায়। সব জায়গায় বিকল্পদের অবস্থাও তথৈবচ। দাদারা পরিবর্ত তৈরি হতেও দেবেন না। যদি রাজপাট চলে যায়!
মানে ‘আর কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না’ বলেই থেকে যাচ্ছেন মাথারা। একজন মমতার লোক হয়ে যাচ্ছেন, একজন অভিষেকের। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার, তৃণমূলের নেত্রী এবং রাজপুত্র যেভাবে একটা সময় পুলিশের জাল থেকে পালিয়ে বেড়ানো জলপাইগুড়ির সৈকতকে ভাইস চেয়ারম্যান রেখে দিলেন। এটা খুব বিসদৃশ। এতে জনতার কাছে বার্তা গেল কী? আপনার অপরাধ করে পালিয়ে বেড়ানো লোককে দিব্যি গদিতে রেখে দিতে পারেন। আপনার পার্টিতে কি সৎ লোকের এত অভাব? তা হলে বুঝতে হবে, তৃণমূল তরুণদের আর দলে টানতে পারছে না।
এই যে মালদার চার প্রভাবশালী নেতা আবদুর রহমান বক্সী, তজমুল হোসেন, সাবিনা ইয়াসমিন এবং মৌসম নুর মিলে মমতা-অভিষেকের পছন্দের দুই প্রার্থীকে নির্বাচনে বেইজ্জত করে দিলেন, জেতানোর জন্য তেমন গা ঘামালেন না, তাঁদের কোনও শাস্তি হবে? হবে না। চারজনই অন্য পার্টি থেকে তৃণমূলে এসেছেন। এখন তাঁদের ঘনিষ্ঠরা বলে বেড়াচ্ছেন, বহিরাগতদের জন্য হারতে হল। প্রশ্ন হল, বহিরাগত কে? এই চারজনের পারস্পরিক সম্পর্ক এত তিক্ত, যে কোনও একজনকে দাঁড় করালেই অন্য তিনজন এভাবেই বসে যেতেন। সবচেয়ে বড় কথা, চারজনই সাংসদ হওয়ার পক্ষে চূড়ান্ত অনুপযুক্ত। মোটেই কাজের লোক নন।
এই সমস্যাটাও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। নামগুলো শুধু বদলে দিলে হয়। ইসলামপুরে চৌধুরী-আগরওয়ালের ঝামেলা তো উত্তরবঙ্গে বহুচর্চিত। যে কারণে জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া, গোপাল লামা, প্রকাশ চিকবড়াইক, নির্মল রায়দের মতো লোকদের প্রার্থী করতে হয়। প্রকাশ তো রাজ্যসভার প্রার্থী হওয়ার পরেই লোকসভা প্রার্থী, এত দুর্দশা জেলার। সব শহরেই দেবাশিস প্রামাণিকের মতো ‘মানিক’ উপস্থিত পার্টিতে। সরকারি টাকা নয়ছয় করতে এরা ওস্তাদ। শাসকের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এদের চিহ্নিত করে ছুড়ে ফেলা যাচ্ছে না। সৎ লোকদের টানতে পারছে না কোনও পার্টিই।
এত লিখছি, কিন্তু শুধু তৃণমূলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব দলেই বেনোজল ভর্তি, নেতৃত্বের অভাব এবং তারপর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বিজেপিতে চিফ হুইপ শংকরকে অপছন্দ উত্তরবঙ্গেরই একঝাঁক বিধায়কের। নিশীথ প্রামাণিক বা জন বারলা এতটাই অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্বাচনের পর নাম শোনা যায় না। অন্য শহরের খবরও রাখেন না। একটাও কাজের লোক নন।
কংগ্রেসে আসুন। শংকর মালাকার কবে থেকে শিলিগুড়ি কংগ্রেসের মাথা। পঁচিশ বছরের কাছাকাছি। এতদিন কুর্সিতে, সহকর্মীরাও প্রথম বসার দিনটা ভুলে গিয়েছেন। এত বছরে এই শংকরের অবদান শূন্যও নয়, বলা উচিত মাইনাস। শহরে কংগ্রেসের উত্থানের জন্য কিছু করেননি। একমাত্র লক্ষ্য, হিলকার্ট রোডের পার্টি অফিসটা দখল রাখা। সিপিএমেও এক দশা। অশোক ভট্টাচার্য, শৈলেন সরকারের পর উত্তরবঙ্গের কোনও নেতা নেই, যাঁকে গোটা রাজ্য চেনে। চেনে কী লিখলাম? চেনার কথা ভুলে যান, নামটাও হয়তো জানে না।
বাংলার সামগ্রিক রাজনীতিতে উত্তরের নেতারা গুরুত্ব পান না, এসব কাঁদুনিতে কী লাভ?
এখানেই একটা কথা যোগ করা দরকার। বিকল্প নেই বলে অসৎ ধান্দাবাজদের পদে বসিয়ে রাখার মানে হয় না। গোষ্ঠীচক্র উপেক্ষা করে সৎ লোককে আনুন। অপরিচিত, একটু চুপচাপ হলেও চলবে। যেভাবে লোকসভা ভোটে অনেক তথাকথিত অপরিচিতদের প্রার্থী করে ফল পাওয়া গিয়েছিল। নইলে শাসকদের সমস্যা মিটবে না।
আমাদের এই পোড়ার বাংলায় সব শহর দেবাশিস প্রামাণিকের মতো ‘মানিক’-এ ছেয়ে গিয়েছে, যারা স্থানীয় দাদাদের ছত্রছায়ায় অন্য মূর্তিতে। পরিবর্ত খোঁজা হয় না বলেই ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় পড়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গের রাজনীতি।