- কল্যাণময় দাস
১৮৫ বছর আগে ডুয়ার্স অঞ্চলে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাজ আমলে, দার্জিলিং জেলা এবং উত্তরবঙ্গের সংলগ্ন এলাকায় চা গাছ রোপণ শুরু হয়েছিল। যা এখন কয়েকশো মিলিয়ন চা শিল্পে পৌঁছেছে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, কিশনগঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের চা বলয় শুধুমাত্র চা চাষেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও চা বলয়ের মানুষের জন্য তাঁদের জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে অনুসারী শিল্পস্থাপনের আওয়াজ কেউই তোলেনি এবং সরকারের পরিকল্পনার অংশেও এই বিষয়টা উঠে আসেনি।
সাংস্কৃতিক কারণে এবং ভ্রমণের জন্য আমাকে বছরের অনেকটা সময় এই চা বলয়ের ভেতরে কাটাতে হয় নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে। তাঁদের কথাবার্তায় এই ক্ষোভ হামেশাই ফুটে ওঠে। চা বাগানকে ঘিরে অন্য কোনও শিল্পই গড়ে উঠল না। চা বাগানকে ঘিরে অনুসারী শিল্প গড়ে উঠতে পারে তার কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই হয়নি কখনও। এই বিষয়ে কোনও পরিকল্পনাই করা হয়নি কোনও সরকারের আমলে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী স্বপ্রণোদিত বাণিজ্য গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও, শুধুমাত্র জমি-জল আর বিদ্যুতের জোগানের অভাবে তাঁরা তাঁদের এইসব অনুসারী কারখানা তৈরি করতে পারেননি। ইংরেজ আমল থেকে বর্তমান সরকার– কোনও সরকারই এই সদিচ্ছা দেখায়নি। অথচ দুর্গাপুর-আসানসোল বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরের যে কোনও বৃহৎ শিল্পাঞ্চলে কিন্তু পাশাপাশি অনুসারী শিল্প আছে।
রিজিওনাল লেবার কমিশনার, উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের ‘সিনপসিস অন সার্ভে অফ টি গার্ডেনস’ ২০১৩ সালের মে মাসে লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ এই পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সের চা বাগিচায় বসবাস করেন। ২০২৪ সাল অবধি ধরা যেতে পারে আনুমানিক ২৫ লক্ষ। এখানে তৈরি হতে পারত কাপড়ের কারখানা। পাশেই কোচবিহার জেলায় উৎপন্ন হয় প্রচুর পাট, যেটা ব্যবহার করা যেতে পারত কাপড়শিল্পে। কিন্তু কেউই ভাবলেন না এই বিষয়গুলো। এর জন্য সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও কোনও অর্থনৈতিক বছরে শোনা গেল না।
এখানে করা যেতে পারত হাতা-খুন্তি-বাসনের কারখানা। করা যেত বনজ ওষধি-জাত আয়ুর্বেদ ওষুধের কারখানা, কারণ এখানে আছে বহু প্রাচীন অরণ্য এবং যে অরণ্যে রয়েছে কয়েক হাজার বনৌষধি। করা যেতে পারত কাগজ তৈরির কারখানাও, কেননা উত্তরের এই অঞ্চলে বাঁশের ফলন প্রচুর। করা যেতে পারত সুপারিজাত বিভিন্ন মশলা এবং জৈব সারের কারখানা। অরণ্য-পাহাড় এবং চা বাগানকে কেন্দ্র করে আজ অবধি কোনও সুস্থ এবং সঠিক পরিকল্পনা তৈরিই করা গেল না।
মিছিলে শুধু চিৎকার, সভায় বর্ণময়-আলোকন, চা গাছের পাতায় পাতায় ইস্তাহার, রেইন ট্রি-র মাথায় মাথায় স্বপ্নের চা বলয়।
এই দুয়ারে প্রকৃতির বৈভব প্রচুর, অনেক কাঁচামাল। আগ্রহীরা জমি-জল-বিদ্যুতের অভাবে পিছিয়ে গেলেন। পাশেই ভুটান, বসরা নদীর বুকে সিমেন্ট কারখানা তৈরি করে প্রচুর কর্মসংস্থান করেছে, যেখানে এই চা বলয়ের তো বটেই, উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েরাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। এই শতকের মুখে এসেও এই বেদনা এবং ক্ষোভ আমাদের মনের ভেতরে গুমরে মরে আর চা বলয়ের নানা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতি বছর শুধুমাত্র চা বাগানে তালা পড়ে যাবার ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন।
(লেখক কোচবিহারের নাট্যশিল্পী)