জলপাইগুড়িঃ হন্তদন্ত হয়ে সার্কিট বেঞ্চের গেট দিয়ে এক আইনজীবী বাইরে এলেন। চোখ-মুখ গম্ভীর। তাকে দেখেই রাস্তার উলটো দিকে বাইকে বসে থাকা চাপদাড়ি মাঝবয়সি একজন এগিয়ে এলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন। মিনিট খানেক ফিশফিশ করে কথা বলে আইনজীবী চলে গেলেন আদালতের ভেতরে। যাঁরা এতক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন তাঁদের দু’তিনজন ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দুজন দ্রুত বাইক স্টার্ট দিয়ে পোস্ট অফিসগামী রাস্তা ধরলেন। এর মধ্যেই একজনকে ফোনে বলতে শোনা গেল, ‘আরে সব কেচে গেল। জামিন হয়নি। উকিল তো বলছে অ্যারেস্ট না কি করতেই হবে। ভোটের সময় মহা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল।’
হাইকোর্টে অস্বস্তি বাড়ল তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের। দম্পতির আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দিল হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ। বিচারপতি সৌমেন সেন এবং রাজা বসু চৌধুরীর এজলাসে মামলাটি শুনানির পর শুক্রবার রায় ঘোষণা করে আদালত। ফলে, সৈকতের গ্রেপ্তার হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন আইনি বিশেষজ্ঞরা। সৈকতের জামিন নাকচ হওয়ার পর থেকেই নেতাকে ধরতে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। শুক্রবারের পর শনিবারও তল্লাশি জারি জারি রেখেছে পুলিশ। জলপাইগুড়ির পাশাপাশি শিলিগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকাতেও তল্লাশি চালিয়েছে জলপাইগুড়ি পুলিশের একটি দল। সূত্রের খবর হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছে সৈকত চট্টোপাধ্যায়।
এদিকে শুক্রবার জলপাইগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হওয়ার খবর বাইরে আসার পর শহরজুড়ে ছড়িয়ে যায় সৈকতের জামিন নাকচের খবর। সেই খবর ছড়াতেই শুনসান হয়ে যায় জেলা তৃণমূলের পার্টি অফিস থেকে সৈকতের বাড়ি, আড্ডা-আসর। বিপদ বুঝে সরে পড়েন সৈকতও। শুনানি শুরুর খানিক আগেই তাঁকে সার্কিট বেঞ্চে ঢুকতে দেখেছিলেন অনেকেই। তবে শুনানি শেষে তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে যান। এদিন ডিভিশন বেঞ্চের তরফে বিচারপতি সৌমেন সেন আইনজীবী কল্লোল মণ্ডলকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “সৈকত চট্টোপাধ্যায় খুবই প্রভাবশালী। আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা থাকা সত্ত্বেও উনি জলপাইগুড়ি শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুলিশ কিছু করেনি। সুইসাইড নোটে সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের নাম রয়েছে। আইপিএস অফিসার জয়রামনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর এই মামলার অগ্রগতি হয়েছে। আদালতে সিডি দাখিল করা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলেছে। তদন্তের স্বার্থে সৈকত চট্টোপাধ্যায়কে আগাম জামিন দেওয়া যাবে না। তাই আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করা হল।’
স্টেশন রোডের তৃণমূলের পার্টি অফিসটি শহরে জয় (সৈকতের ডাক নাম)-এর অফিস হিসাবেই পরিচিত। এদিন বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন হুটার বাজিয়ে এক বিচারপতির কনভয় পার্টি অফিসের দিকে যাচ্ছিল তখন একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন সৈকতের এক খাস সমর্থক। দাদা কোথায়? আমতা-আমতা করে বললেন, ‘থানা মোড়েই আছে মনে হয়। থানা মোড়ে জয়ের আসরে তখন মাছি মারার লোক নেই। এর মধ্যেই সবক’টা মোবাইল ফোন ‘সুইচড অফ’ করে দিয়েছেন সৈকত।
পুরসভার পাশের গলিতেই সৈকতের বাড়ি। অন্যদিন সেই গলি ভরে থাকে অনুগামীদের ভিড়ে। আজ গলি শুনসান। দেওয়ালের পাইপ চুইয়ে রাস্তায় জল পড়ার শব্দও খানিকটা দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। বাড়ির নীচতলার একটি ঘরে সৈকতের “ভিজিটর রুম। দরজার বাইরের দুটো কলিং বেল খানিক পরপর চারবার বাজালেও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এর মধ্যে কিছু কাগজ হাতে একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী এসে সটান ভিজিটর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘দাদা তো নেই ভেতরে।’ কোথায় গিয়েছেন?’
ভরা ভোটের বাজারেও এদিন রায় ঘোষণার পর থেকেই বাবুপাড়ায় বন্ধই দেখা গিয়েছে জেলা তৃণমূলের পার্টি অফিস। অফিসের অদূরে চায়ের দোকানে তখন ফিশফাশ চলছে। আলোচনার বিষয় একটাই- কী হবে সৈকতের। নানাজনে নানা কথা বলছেন। তার মধ্যেই এক প্রবীণ রাশভারী গলায় বলে উঠলেন, ‘আরে ভাই আমিও তৃণমূলের সমর্থক। কিন্তু এটা বুঝতে হবে জয়রামন এলেবেলে অফিসার নয়। ডিএম-কে গ্রেপ্তার করেছিল। সৈকত ওর কাছে শিশু।’
সৈকতকে গ্রেপ্তার করতে সন্ধ্যায় বিশাল পুলিশবাহিনী তাঁর বাড়ি, চেম্বার, শহরের একাধিক হোটেল সহ তাঁর বিভিন্ন ঠেকে অভিযান চালায়। কোতোয়ালি থানার আইসি অর্ঘ্য সরকার ও মামলার তদন্তকারী আধিকারিক নীতেশ লামার নেতৃত্বে তিনটি গাড়ি নিয়ে পৌনে আটটা নাগাদ অভিযান শুরু করে পুলিশ। শুরুতেই হানা দেয় সৈকতের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে প্রতিটি ঘরে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। ঘরের ভেতর একদল পুলিশ দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন সৈকতের স্ত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। সৈকতের স্ত্রীর কান্নাকাটির কথা শুনে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক এক ব্যক্তির টিপ্পনী, ‘হিরো হয়ে ঘুরত। ওর জন্য যে কতজনের চোখের জল ঝরেছে তার ঠিক নেই। এখন ওর স্ত্রী কাঁদছে। এটাই বিধাতার খেল।’
মিনিট দশেকের তল্লাশির পরও তাঁকে না পেয়ে ক্লাব রোডের একটি হোটেলে ঢোকে পুলিশ। সেখানে আধ ঘণ্টা তল্লাশি চলে। পুলিশের কথায় ওই হোটেল সৈকতের অন্যতম ডেরা। সেখানেও তাঁর হদিস মেলেনি। এরপর পুলিশবাহিনী চলে যায় থানার পেছনে সমাজপাড়ার একটি বিলাসবহুল অনুষ্ঠান ভবনে। মিনিট সাতেকের খোঁজাখুঁজির পর সেখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয় পুলিশকে। সৈকতের বিরুদ্ধে যে শহরজুড়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে এদিন বহু মানুষের কথায় তার আভাস মিলেছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এক সিভিক ভলান্টিয়ারও চুপিচুপি সৈকতের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে গেলেন।
অভিযান শেষে রাত ন’টা নাগাদ পুলিশের গাড়ি থানায় ঢোকে। তা দেখে সামনের দোকানে চায়ে চুমুক দিতে দিতেই থানার গেটে উকি দিলেন বছর পঁচিশের যুবক প্রবীর সেন। গ্রেপ্তার হয়নি বুঝে রাগে পুলিশকে গালাগাল দিলেন। কাগজের কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে যেতে যেতে বললেন, ‘অহংকারেই পতন। বুঝলেন দাদা। দল ক্ষমতায় আর ও এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’ বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গেলেন প্রবীর। সেই হাসিতে যেন একটাই প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল, অব তেরা ক্যায়া হোগা রে …. ..