- আশিস ঘোষ
দালাল। খুব চেনা একটা শব্দ। আকছার বলা হয়। ইংরেজিতে বললে ব্রোকার। কেউ আবার বলেন এজেন্ট। কেউ টাউট। ইংরেজিতে তবু খানিকটা ইজ্জত থাকলেও গোদা বাংলায় দালাল শব্দটায় কোনও সম্ভ্রম নেই। গালাগালির মতো। দালাল তো কতরকমের হয়। জমি-বাড়ির দালালি থেকে কর্পোরেশনে কাজ করানোর দালাল, স্কুল-কলেজে ভর্তি করার দালাল, বড় বড় ব্যবসায়ীদের নানারকম কনট্রাক্ট পাইয়ে দেওয়ার দালাল, বিমার দালাল, নেতা ধরে চাকরি জোটানোর দালাল আরও কত কী!
রাজনীতির বাজারেও দালালরা রয়েছে বহু যুগ ধরে। নানা চেহারায়। নানা নামে। তাদের দাপট অনেক। তারা হয় কে নয় করাতে পারে। তাদের চাহিদা তাই অনেক। তারাও ব্রোকার, তবে জাতে একটু কুলীন, পাওয়ার ব্রোকার। লবিইস্ট। এদের দর, কদর যথেষ্ট। রাজনীতিতে দালালি অনেক দিনের। ছোটবেলায় শুনতাম আমেরিকার দালাল। আরও বড় গাল ছিল সিআইএ’র দালাল। সেই যে ছড়াকার লিখেছিলেন, ‘হাঁড়ির মধ্যে অনেক ভাত/তার একটি টিপিয়াই/কোনটি দালাল সিআইয়ের/ বলতে পারেন সিপিআই।’
সে আমেরিকাও নেই, সেই সিআইএ’র রমরমা বাজারও নেই। মাঝে দিল্লির রাজনীতির বাজার ছিল বফর্সের দালালি নিয়ে সরগরম। তার ধাক্কায় কংগ্রেসের গদি উলটে গিয়েছিল। ফলে দালালি যে নেহাত হেলাফেলার জিনিস এমনটা নয় এ কালে। কাউকে কারও দালাল বলে দেগে দিলেই হল। যা বোঝার লোকে বুঝে নেবে। রাজনীতির আখড়ার কাদা ছোড়াছুড়িতে দালাল বেশ একটা জুতসই গালি।
এখন, এই ভোট বাজারে কে যে কার দালাল ঠাহর করা দায়। সকলেই কারও না কারও দালাল। যেমন তৃণমূলের কাছে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বিজেপির দালাল। সিপিএম, আইএসএফ বিজেপির দালাল। মমতার ভাষায়, তারা জগাই-মাধাই-গদাই। এদের কাজই হল তলে তলে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অষ্টপ্রহর রাজ্যের সরকারকে বিপদে ফেলার ফন্দি আঁটা। অর্থাৎ এই তিন দল মুখে যাই বলুক, কাজে দালালি করছে মোদির। বহুদিন হল এটাই তৃণমূল নেত্রীর ভাষণের মোদ্দা কথা।
আবার ইন্ডিয়া জোট যখন হল, দিল্লির নেতারা যাই বলুন, এ রাজ্যে দুই সিটের মালিক কংগ্রেস গোড়া থেকেই আপত্তি করেছে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে। অধীরের তো এটাই ওয়ান পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা। মমতাকে বিজেপির দালাল তো বটেই, এমনকি বিজেপির ইনফর্মার বলতেও ছাড়েননি তিনি। অর্থাৎ কংগ্রেসের কাছে দালাল আবার তৃণমূল। বামেদের কাছেও তৃণমূল বরাবরই বিজেপির দালাল। একসময়, সে বছর কুড়ি আগে বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছিলেন মমতা। তাই একসময়ের ‘আধা ফাসিস্ত’ কংগ্রেসের সঙ্গে গলায় গলায় দোস্তি হলেও দালাল তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলানো নৈব নৈব চ। তৃণমূলের কাছে আইএসএফ বিজেপির দালাল, তাদের কাছ থেকে টাকা খায়। আবার স্রোতে ভেসে দলে ভেড়া তৃণমূলের নেতাদের বিশ্বাস করে না আদি বিজেপির নেতা-কর্মীরা। সেইসব দলবদলুরা যে কোনও সময় তৃণমূলে ফিরে যেতে পারে বলে তাদের স্থির বিশ্বাস। তারা তলে তলে মমতার দালাল।
অর্থাৎ আপাতত ভোটের তর্জায় সবাই দালাল। মমতা বলছেন, রাম-বাম-শাম জোট বেঁধে কোর্টে গিয়ে চাকরি আটকাচ্ছে। জোট বাঁধছে দালালরা। তাদের লক্ষ্য হল যেনতেনপ্রকারেণ বিজেপির সাচ্চা, আগমার্কা বিরোধী তৃণমূলকে বিপদে ফেলা। আসল মতলব বিজেপিকে মদত দেওয়া, তা সে টাকা খেয়েই হোক বা না খেয়ে। সিপিএম আবার এনেছে ‘সেটিং’ তত্ত্ব। তাদের কথা, এখানে যতই হাত-পা ছুড়ুক, মোদি-মমতা সেটিং হয়ে আছে। ক’টা সিট গোপনে বিজেপিকে ছাড়বে তৃণমূল তা ঠিক হয়ে আছে আগে থেকেই। মোটেই দেশের হিতে নয়, তাদের আসল মতলব অভিষেককে ইডি-সিবিআই থেকে রক্ষা করা। ইডি-সিবিআই আবার কেন্দ্রের এজেন্ট, এমনটাই গাল দেয় জোড়াফুল।
বস্তুত এখানে বিজেপির কত দালাল আছে তার লিস্ট যতই লম্বা হোক না কেন, একা অধীরই তৃণমূলের বিচারে সেরা দালাল। তাদের কথা, এই দালালশ্রীর জন্যই বঙ্গে জোট ভেস্তে গেল। কংগ্রেসের হাইকমান্ড যতই মমতাকে খোশমেজাজে রাখার কথা বলুক, একা অধীরই দান উলটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।