ভাস্কর শর্মা, আলিপুরদুয়ার: ডুয়ার্সের চা বলয়ে সাদরি ভাষায় একটি কথা প্রচলন আছে- ‘চা বাগান যেকার, পঞ্চায়েত সেকার।’ অর্থাৎ চা বাগান যার পঞ্চায়েত তার। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। তাই সাদরি ভাষার এই প্রবাদ বাক্যটিই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি নেতৃত্বের। কারণ, আলিপুরদুয়ার জেলার একটি চা বাগানও তাদের দখলে নেই। অর্থাৎ জেলার কোনও চা বাগানেই নেই তাদের পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েত। এই অবস্থায় চা বাগান মহল্লায় লোকসভা ভোটের আগে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলেই বিজেপির অন্দরে খবর। তবে অবস্থা বদলাতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা মিটলেই জেলার দুই জায়গায় সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপির জেলা নেতৃত্ব।
বিজেপির আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি বিধায়ক মনোজ টিগ্গা বলেন, ‘জেলার চা বাগান এলাকায় আমাদের দখলে পঞ্চায়েত না থাকলেও সংগঠন আছে। এমনকি ভোটব্যাংকও শক্তপোক্ত। এই ভোটব্যাংককে আরও বৃদ্ধি করতে মার্চ মাসে চা শ্রমিকদের নিয়ে দুটি সভা করব। সেখানে রাজ্য নেতৃত্ব উপস্থিত থাকবেন।’
আলিপুরদুয়ার জেলা বিজেপি সূত্রে খবর, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই চা শ্রমিকদের নিয়ে সভা করা হবে। দুটি সভাই অবশ্য ঘরোয়াভাবে করার পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে একটি সভা আলিপুরদুয়ার শহরে ও অপর সভাটি ফালাকাটায় হবে। আলিপুরদুয়ারের সভায় কুমারগ্রাম, কালচিনি এবং আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকের চা শ্রমিকরা উপস্থিত থাকবেন। ফালাকাটায় সভাটি জটেশ্বরে হবার সম্ভাবনা আছে। সেখানে ফালাকাটা ও মাদারিহাট এবং বানারহাট ব্লকের চা শ্রমিকদের থাকার কথা। সভার তারিখ এখনও ঠিক না হলেও সেখানে রাজ্য নেতৃত্ব থাকার সম্ভাবনা আছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার অথবা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দুই সভাতে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর।
এদিকে জানা গিয়েছে, আলিপুরদুয়ার জেলায় ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে মোটামুটি ভালো ফল করেছিল বিজেপি। সেবার ৬৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমূল পায় ৪৩টি এবং বিজেপি পায় ৯টি। বাকি ১টি করে পায় সিপিএম ও কংগ্রেস। বাকি ১২টি অবশ্য নির্দল প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। জেলার ৬টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ৫টি তৃণমূল এবং ১টি বিজেপি দখল করেছিল। আবার জেলা পরিষদের ১৮টি আসনের মধ্যে ১৭টি তৃণমূল ও ১টি বিজেপি পেয়েছিল। ২০১৯ সালে লোকসভা আসন দখল করে বিজেপি। ২০২১ সালে জেলার ৫টি বিধানসভাও দখল করে বিজেপি। পঞ্চায়েত ভোটে তেমন সাফল্য পায়নি বিজেপি। জানা গিয়েছে, জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েত আছে ৬৪টি। আর চাবাগান আছে ৬৮টি। এই ৬৮টি চা বাগান আবার ৩৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়েছে। চা বাগান অধ্যুাষিত এই ৩৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে এবার একটিতেও জিততে পারেনি বিজেপি। বিজেপি যে চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছে তা কৃষি বলয়ে। গত বিধানসভায় অবশ্য বিজেপির চা বাগানে ভালো ফল করে। কিন্তু পঞ্চায়েতে আবার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছে। এই অবস্থায় গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজ করছে শাসকদল। কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে না থাকায় বুথ স্তরে পৌঁছাতে বেগ পাচ্ছে বিজেপি নেতৃত্ব বলেই খবর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা স্তরের এক বিজেপি নেতা বলেন, ‘গত লোকসভা ভোটের আগে বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত আমাদের দখলে ছিল। তখন আমরা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গোটা চা বাগানেই ভোটব্যাংক তৈরি করেছিলাম। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আলাদা। একটি গ্রাম পঞ্চায়েতও আমাদের নেই। তাই এলাকায় গিয়ে চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা পুরোনো নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে অবস্থা ফেরাতে কাজ করছি।’
এদিকে জানা গিয়েছে, পঞ্চায়েতগুলিতে বিজেপি কিছুটা বেগ পেলেও শাসকদল কিন্তু চা বাগান চষে বেড়াচ্ছে। চা সুন্দরি, জমির পাট্টা, ঘরের টাকা সহ একাধিক প্রকল্প যে লোকসভার ভোটের প্রচার শুরু করে দিয়েছে। তৃণমূলের আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি প্রকাশ চিকবড়াইক বলেন, ‘স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এসেও একটি চা বাগানও অধিগ্রহণ করতে পারেননি। বিজেপি এমপি-বিধায়করাও চা শ্রমিকদের উন্নয়নে কোনও কাজ করেননি। তাই তারা কোন মুখে চা মহল্লায় যাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চা বাগানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন। আমরা তাই লোকসভা ভোটে অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ পাব বলেই আশা রাখছি।’