সৌরভকুমার মিশ্র, হরিশ্চন্দ্রপুর : উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে গিয়ে ওঁরা কেউ উত্তরপ্রদেশে, কেউ নয়াদিল্লি, কেউ রাজস্থানে থিতু। কেউ আবার বেঙ্গালুরুতে কিংবা মুম্বইয়ে। অবশ্যই কলকাতায়।এমন পরিস্থিতি হলে আপনারা অবধারিত ভাববেন, এঁরা সেই পরিযায়ী শ্রমিক। খুব কষ্ট করে সংসার চালাতে নিজের গ্রাম ছেড়েছেন। ভুল ভাবছেন।
মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর থানার চণ্ডীপুর গ্রাম এসবের মধ্যে একেবারে আলাদা। এই গ্রামের ছেলেদের পেশার জোরে চণ্ডীপুর শুধু উত্তরবঙ্গ কেন, ‘দেশের রান্নাঘর’ হয়ে ওঠার দাবিদার হতে পারেন। পরিযায়ী শ্রমিকের পেশাকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছেন এঁরা। যাঁদের রান্নার স্বাদের জের ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে।
মালদা ও বিহারের সীমান্ত এলাকায় রশিদাবাদের কাছে এই গ্রাম। সেখান থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এলাকার ছেলেরা ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। তাঁদের অধিকাংশেরই পেশা রান্না করা। রাজস্থান থেকে তামিলনাডু, দেশের প্রায় সব রাজ্যে ছোট-বড় নামীদামি হোটেল, রেস্তোরাঁয় এঁরা কখনও প্রধান শেফ কিংবা সহকারী শেফ হিসাবে কাজ করে চলেছে দশকের পর দশক ধরে। এঁদের রান্নায় দক্ষতা দেখে দেশে মালদা এবং হরিশ্চন্দ্রপুরের লোকদের বিশেষ কদর বাড়ছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে।
কথা হচ্ছিল চণ্ডীপুরের বাসিন্দা বছর ষাটের সাদেক আলির সঙ্গে। বর্তমানে এলাহাবাদের বুখারা-তে কর্মরত সাদেক। প্রায় সারা জীবনই কাটিয়ে দিলেন এই পেশাতে কাজ করে। তাঁর মন্তব্য, ‘অনেকদিন ধরে এই পেশায়। আমাদের বাবা-কাকারা এলাকার রাঁধুনি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের দেখেই শেখা।’ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করে এখন এলাহাবাদে। প্রথমদিকে শেফদের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। এখন এই পেশা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
আর এক পরিচিত নাম সফিকুল ইসলাম। বর্তমানে লখনউয়ের নামী রেস্তোরাঁ টুন্দে কাবাবের প্রধান শেফ। মূলত তৈরি করেন গালৌটি কাবাব। সফিকুল হাসেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক রেস্তোরাঁয় কাজ করেছি বহু বছর। অনেক রান্নাবান্না-রেসিপি জানা। তবে উত্তর ভারতীয় এবং মোগলাই খানাই বানাতে ভালো লাগে।’
দুজনের কাছেই জানা গেল, চণ্ডীপুরের অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। শুধু মোগলাই নয়, বিভিন্ন ঘরানার রান্নাতে পারদর্শী এঁরা। তবে মোগলাই খানাতেই এঁদের রমরমা এবং উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরেই এঁদের বেশি দেখা যাবে। লখনউ, বেনারস, কানপুর, এলাহাবাদ..। তবে ইডলি-ধোসাতেও এঁরা পটু অনেকে।
চণ্ডীপুরের ফিরোজ আলি বর্তমানে কলকাতার নামী বিরিয়ানি ব্র্যান্ডের রেস্তোরাঁয়। বলছিলেন, ‘তন্দুরি আর বিরিয়ানির দিকটাই আমি এখানে দেখি। কলকাতায় কাজ করার আগে গুজরাটে ছিলাম। সেখানে একটি হোটেলে কাজ করেছি পাঁচ বছর। ভিনরাজ্যে পড়ে থাকতে আর ভালো লাগেনি। তাই কলকাতায় চলে এসেছি।’ ফিরোজের কথা শুনে মনে হল, এঁরা বেশ ভালোই আছেন। তাঁর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, নিজেই রেস্তোরাঁ খুলে ব্যবসা করার।
কী করে ঠিক এই জায়গা থেকে রাঁধুনিরা উঠে আসছেন গণহারে? সমাজতত্ত্বের বিচারে কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব জানতে সেখানকার শিক্ষাজগতের লোকদের সঙ্গে কথা বললে বেশ কিছু তত্ত্ব উঠে আসে।
চণ্ডীপুরের মানুষ মণিরুল ইসলাম রাজি উত্তর দিনাজপুরের একটি হাই মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘এই গ্রামে বেশ কতগুলি পরিবার আছে, যারা রান্নাবান্নার কাজের সঙ্গে যুক্ত বহু বছর। এরা বংশপরম্পরায় এই কাজ করে। ওদের পূর্বপুরুষরা আগে গ্রামগঞ্জে বিয়েবাড়ি সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানবাড়িতে রান্নাবান্না করতেন। বর্তমান প্রজন্ম এখন গ্রামে পড়ে থাকতে চাইছে না। ওরা ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে শুধুমাত্র রান্নার কাজের তাগিদেই।’ প্রবীণ ক্রীড়া প্রশিক্ষক রেজা রাজি হিসেব দিলেন, এলাকায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন যুবক বাইরে রান্নার কাজের সঙ্গে যুক্ত। ‘এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিরিয়ানি বানানোয় দক্ষ, অনেকেই টিক্কা কিংবা কাবাব স্পেশালিস্ট। আবার কেউ হান্ডি জাতীয় রান্নায় মাস্টার। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভিনরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন।’
অনেকদিন কাজ চলছে বলে উলটো স্রোতও রয়েছে এখানে। বাইরে দীর্ঘদিন কাজ করার পর এখন অনেকেই গ্রামে চলে আসছেন। এসে হরিশ্চন্দ্রপুর, তুলসীহাটা, চাঁচলে নিজেদেরই হোটেল খুলছেন। এর মধ্যেও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী রয়েছে। একদা লখনউ এবং কলকাতায় নামকরা রেস্তোরাঁয় শেফ মনসুর রহমান প্রধান শেফ ছিলেন। সেখানে প্রধান রাঁধুনির কাজ ছেড়ে এখন গ্রামে টোটো চালান। স্বপ্ন ছিল, নিজস্ব রেস্তোরাঁ খুলবেন জেলায়। পরিবারকে সময় দিতে পারবেন। বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক অবস্থা। এর পরে কাপড় ফেরি করতে শুরু করেন। বেশিদিন চলেনি সেই ব্যবসা। এরপরে সেকেন্ড হ্যান্ড অটো নিয়ে চালাতে শুরু করেন। এখন নিজস্ব টোটো আছে মনসুরের। নিজেই চালান।
তবে ‘বাংলার রান্নাঘর’ হয়ে ওঠা চণ্ডীপুরে মনসুররা ব্যতিক্রমী। সেখানে এখনও স্বপ্ন ছড়ান সাদেক-সফিকুল-ফিরোজরা। বাতাসে ওড়ে বিরিয়ানির গন্ধ।