সপ্তর্ষি সরকার, ধূপগুড়ি : পাঁচ বছর আটকে থাকার পর ফের প্রাথমিক স্কুলগুলির প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ (ডিপিএসসি)-এর হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। তবে ঠিক কী প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। শেষপর্যন্ত ৩১ জুলাই কলকাতায় রাজ্যের সমস্ত ডিপিএসসি’র চেয়ারম্যান এবং ডিআই-দের উপস্থিতিতে পর্ষদের সভায় চূড়ান্ত হয়েছে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া। পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে এই রাজ্যের প্রাথমিক স্কুলগুলির প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। আগের মতো শুধুমাত্র সার্কেল ভিত্তিক সিনিয়ারিটি প্যানেলের ভিত্তিতে আর প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হবে না। তার বদলে আধিকারিকদের অনুমোদন করা শিক্ষকের স্বমূল্যায়ন, সিনিয়ারিটি এবং ইন্টারভিউর মাধ্যমে তৈরি মেধাতালিকা অনুসারে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হবে।
মোট ১০০ নম্বরের বাছাই প্রক্রিয়ায় ৬০ পেলে তবেই মেধাতালিকায় স্থান মিলবে। এক বছরের জন্যে তৈরি হবে ওয়েটিং লিস্ট সহ মেধাতালিকা। তার ভিত্তিতে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে হবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ। জলপাইগুড়ি জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি লক্ষমোহন রায় বলেন, ‘পর্ষদ বিস্তারিত প্রক্রিয়া জানিয়েছে। এর ভিত্তিতে খুব দ্রুত আমরা জেলায় নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করব। সার্কেল স্তর থেকেই কাজ শুরু হবে।’ পর্ষদ এবং বিভিন্ন ডিপিএসসি সূত্রে খবর, পুজোর ছুটির আগেই ঘোষিত নতুন পদ্ধতিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যাতে চলতি শিক্ষাবর্ষেই রাজ্যজুড়ে নিয়োগ শেষ করা যায়।
যদিও পর্ষদ ঘোষিত নতুন নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বাম শিক্ষক সংগঠন এবিপিটিএ’র জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক বিপ্লব ঝা’র বক্তব্য, ‘আমরা প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে। তবে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তার যৌক্তিকতা বুঝতে পারছি না। এতে প্রবীণ শিক্ষকদের বঞ্চিত করে রাজনৈতিক মদতপুষ্টদের নিয়োগের পথ প্রশস্ত হয়েছে।’
পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেলাভিত্তিক শূন্যপদ নির্ধারণের পর পর্ষদের ওয়েবসাইট এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে ইচ্ছুক ও যোগ্য সহকারী শিক্ষকদের থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হবে। এক্ষেত্রে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই আবেদন করা যাবে। আবেদনের সঙ্গেই মোট ৫০ নম্বরের স্বমূল্যায়ন রিপোর্ট জমা দেবেন সহকারী শিক্ষক। শিক্ষাদান থেকে পাঠক্রম এবং স্কুল ও পড়ুয়াদের সহশিক্ষামূলক কাজে নিজের ভূমিকার নিজেকেই মূল্যায়ন করে নম্বর দিতে হবে আবেদককে। এজন্যে ‘এ’ এবং ‘বি’ দুটো ক্যাটিগোরি ভাগ করা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটিগোরিতে চারটি বিষয়ে মোট ১০ নম্বরের মূল্যায়ন থাকবে যার মধ্যে প্যানেলে থাকতে গেলে অন্তত ৬ নম্বর পেতেই হবে। এমন তিন বছর নিজের কাজের মূল্যায়নে মোট তিরিশ নম্বর থাকবে।
এরপর ‘বি’ ক্যাটিগোরিতে তিনটি বিষয় মিলে মোট ২০ নম্বরের স্বমূল্যায়ন করবেন আবেদনকারী। এখানে তাঁর ন্যূনতম ১২ নম্বর পেতে হবে। এছাড়া বছর প্রতি ৫ নম্বর করে সর্বোচ্চ ৫০ নম্বর অভিজ্ঞতার জন্যে থাকবে, যার মধ্যে ন্যূনতম ৩০ নম্বর পেলেই নাম উঠবে মেধাতালিকায়। আবেদকদের স্বমূল্যায়নের ভিত্তিতে নিজেদের দেওয়া নম্বর পরীক্ষা করে তাতে অনুমোদন দেবেন এসআই’রা। এরপর হবে কাউন্সেলিং কাম ইন্টারভিউ। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৈরি নূ্যনতম তিনজনের প্যানেল সাক্ষাৎকার নেবেন। আলাদা নম্বর না থাকলেও মান অনুযায়ী চারটি ভাগে আবেদনকারীকে বিচার করবে বিশেষজ্ঞদের ইন্টারভিউ বোর্ড। এর পরেই তৈরি চূড়ান্ত মেধাতালিকা অনুমোদন দিয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করবে ডিপিএসসি।
আমূল বদলে ফেলা এই প্রক্রিয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শাসকদলের শিক্ষক সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি স্বপন বসাক বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় আমরা আনন্দিত। মেধাভিত্তিক যে প্রক্রিয়া পর্ষদ গ্রহণ করেছে তাকে আমরা সাধুবাদ ও সমর্থন জানাই।’
জলপাইগুড়ি জেলায় শেষবার প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। বর্তমানে জেলার ১২০৫টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৯০০টি স্কুলেই প্রধান শিক্ষক নেই। এনিয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষক সংগঠনগুলি আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। ২০১৯ সালে প্রকাশিত রোপা বা রাজ্যের সংশোধিত বেতনক্রমে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদের জন্যে শুধুমাত্র মাসিক ৪০০ টাকা আর্থিক সুবিধা ঘোষিত হয়। এরপর থেকেই প্রধান শিক্ষক পদ নিয়ে কার্যত আগ্রহ হারান সহকারী শিক্ষকরা এবং সংগঠনগুলি।
ডিএ মামলা নিয়ে অনশন আন্দোলনের জেরে সম্প্রতি রাজ্যজুড়ে প্রচারে উঠে আসা অরাজনৈতিক শিক্ষক সংগঠন উস্থি ইউনাইটেড টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক ভাস্কর ঘোষের কথায়, ‘মাত্র চারশো টাকা অস্থায়ী আর্থিক সুবিধা দিতে যে জটিল প্রক্রিয়া ঘোষিত হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য হল এই নিয়ে মামলার সুযোগ করে দেওয়া। এসব নিয়োগ না করার অজুহাত মাত্র। সবার আগে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদের প্রতি আর্থিক বঞ্চনা নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হওয়া দরকার।’