প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: সংসদীয় অলিন্দে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে বৃহস্পতিবার যে অবিশ্বাস্য স্নায়ুযুদ্ধের মহড়া চলল তা কার্যত নজিরবিহীন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ। এদিন সংসদে পালিত হয় ‘কালা দিবস’। মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য রাখার দাবিতে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেও কেন্দ্র সরকারকে চাপমুক্ত রাখতে নারাজ বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট। অনাস্থা প্রস্তাব বিষয়ক ‘বল’ সরকারের ‘কোর্টে’ ঠেলেও দিয়েও মণিপুর ইস্যুতে ‘প্রেসার ট্যাকটিক্স’ নীতিতে ভর দিয়ে, এদিন কালো পোশাক পরে সংসদের দুই কক্ষে হাজির হন বিরোধী দলীয় প্রতিনিধিরা।
সূত্রের খবর, বুধবার রাতে বিরোধীপক্ষের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৃহস্পতিবার কালা পোশাক পরে সংসদে প্রতিবাদ জানাবেন সমস্ত বিরোধী দলীয় সাংসদরা৷ এদিন সকালে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ মল্লিকার্জুন খাড়গের কক্ষে আয়োজিত বিরোধী বৈঠকে চূড়ান্ত হয় এদিনের পরিকল্পনা৷ বিরোধী জোট সাংসদদের কালো পোশাক পরে সংসদে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। কালো পোশাক না পরলেও কালো আর্ম ব্যান্ড বেঁধে আসতেও বলা হয়েছে তাঁদের। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এই কর্মসূচি বলে জানা গিয়েছে।
পরিকল্পনা মাফিক, মণিপুরকাণ্ডের প্রতিবাদে কালো পোশাক পরেই বৃহস্পতিবার সংসদের উভয় কক্ষে হাজির হলেন বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদেরা, রাজ্যসভা বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, লোকসভার বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী, তৃণমূলের দুই কক্ষের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বিভিন্ন বিরোধী সাংসদরা। এদিন অধিবেশন শুরুর আগে গান্ধিমূর্তির নীচে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। মণিপুরকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে স্লোগান তোলেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিজেপি শাসিত রাজ্য মণিপুরে গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিক হিংসা এবং নারী নির্যাতন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনও সংসদে কোনও বিবৃতি দেননি। সেই আবহেই বিরোধী শিবিরের এই সম্মিলিত ‘কালা দিবস’ পালন। পরে সকাল ১১টায় সংসদের উভয়কক্ষে অধিবেশন শুরু হলে ‘ওয়েলে’ নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিরোধীরা, যার জেরে দফায় দফায় মুলতুবি হয় সংসদের কাজ। লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয়কক্ষের অধ্যক্ষরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তবে সব বিরোধী সাংসদরা যে কালো কাপড় পরে এদিন সংসদে হাজির হয়েছিলেন এমনটা নয়। বর্ষীয়ান ডিএমকে নেতা টি আর বালু, তৃণমূল কংগ্রেসের সুনীল মণ্ডল বা সমাজবাদী পার্টি নেত্রী ডিম্পল যাদব সহ একাধিক সাংসদরা সাধারণ পোশাকে বিক্ষোভ শামিল হন। বিরোধী শিবিরের তরফে তাঁদের কালো আর্ম ব্যান্ড বেঁধে দেওয়া হয়।
বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের ‘কালা দিবস’ পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে বলতে গিয়ে কংগ্রেস লোকসভা দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘কালো পোশাক প্রতিবাদ এবং শোকজ্ঞাপনের একটা প্রতীকী মাত্র৷ ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। লোকতন্ত্রের মন্দিরে যদি লোকতন্ত্রের হত্যা হয়, আমরা তার বিরোধিতা করবই। এর আগে অসংসদীয় ঘটনা যতবার ঘটেছে, ততবার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷ সব কিছু এড়িয়ে যাওয়া যায় না।’ মণিপুর প্রসঙ্গে অধীরের সংযোজন, ‘মণিপুরের ঘটনায় সারা বিশ্ব আলোড়িত…আমরা সংসদে আলোচনা চাইছি, আর প্রধানমন্ত্রী বাইরে ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। মোদিজি ভাষণ দিতে ভালোবাসেন, ভাষণ দিয়ে সাদা কালো, সত্যি মিথ্যা, দিন রাত সব উলটে দেন। আমরা তাঁকে বাধ্য করেছি আলোচনার জন্য। এবার সরকারপক্ষ যখন চাইবে, তখনই আলোচনা হবে। স্পিকারের হাতে কিছু নেই, তিনি শুধু সমন্বয় রক্ষাকারী। তবে আমরা প্রস্তুত। যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে আলোচনার জন্য প্রস্তুত ইন্ডিয়া জোট।’
তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান সাংসদ ও দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘কালো পোশাকের অর্থ প্রতিবাদ। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী শিবির একজোট হয়ে কালো পোশাক পরে এই বার্তা দিয়েছে যে মণিপুর ইস্যুতে আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। লড়াই এখনও বাকি। সরকারের এই অনমনীয় মনোভাব, গণতন্ত্রকে অমর্যাদা করার প্রতি বিরোধিতার বার্তা আজকের এই কালা প্রতিবাদ।’
বৃহস্পতিবার সংসদে যখন বিরোধীরা ‘কালা দিবস’ পালন করছে, তখন নিছক মৌনতা ধারণ করে থাকেনি কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি৷ বিরোধীদের প্রবল বিক্ষোভ এবং হইহল্লার মাঝেই পীযুষ গোয়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন জনবিশ্বাস বিল, অর্জুন রাম মেঘোয়ালের ‘রিপিলিং অ্যান্ড অ্যামেন্ডিং বিল’ পাস করানো এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশীর তত্ত্বাবধানে ‘মিনারাল ডেভেলপমেন্ট রেগুলেশন বিল’ পেশ করা হয় লোকসভায়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশনীতি, সাম্প্রতিক বিদেশ সফর এবং বিভিন্ন দেশের তরফে প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে প্রায় ২৫ মিনিটের সুদীর্ঘ রিপোর্ট সংসদের উভয় কক্ষে পেশ করতে গিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়েন কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী ড. সুব্রহ্মনিয়ম জয়শঙ্কর৷ অধীর চৌধুরী, সৌগত রায়ের মতো বর্ষীয়ান বিরোধী নেতারা উঠে দাঁড়িয়ে এই ‘অতিকথনে’র তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানালে, তাঁদের মাইক বন্ধ করে দেন স্পিকার প্যানেল কিরিটভাই সোলাঙ্কি। এর ফলে আরও উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। হইহট্টগোলে ভরে ওঠে সংসদীয় কক্ষ। পালটা তোপ দেগে, অধীর চৌধুরীর বক্তব্য রুখে দেন পীযুষ গোয়েল নেতৃত্বাধীন ট্রেজারি বেঞ্চ৷ গোয়েল তর্জনি তুলে সরাসরি বলেন, ‘বিদেশমন্ত্রীকে বক্তব্য রাখার সময়ে বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে। আমরাও অধীর চৌধুরীকে বক্তব্য রাখতে দেব না।’ এহেন প্রচ্ছন্ন মদতে ফুঁসে ওঠে শাসক দলীয় বেঞ্চ, লোকসভায় আছড়ে পড়ে ‘মোদি মোদি’ রব যার পালটা ‘ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া’ জয়ধ্বনি ওঠে বিরোধী শিবিরের তরফে৷
বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের কালা দিবস পালনকে বেনজির কটাক্ষ হেনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযুষ গোয়েল বলেন- ‘কালো কাপড়ের আড়ালে কী লুকোতে চাইছেন বিরোধীরা? এদের কালো ধন, কালো কুকীর্তি ঢাকবার জন্য এই পন্থা। এমনই দুরাবস্থা যে কাকেও ঠোঁকর মারতে ছাড়ে না বিরোধী নেতাদের।’ পীযুষ এও জানান, ‘বিরোধীদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই কালো। তবে আমরা আশাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুশাসনে তাঁদের (বিরোধী শিবির) জীবনেও ফুটবে সুখ সমৃদ্ধির আলো।’ বিরোধী শিবিরকে কটাক্ষ করে বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরি বলেন, ‘এদের অন্তরাত্মা কলুষিত, তাই এরা কালো কাপড় পরেছে৷’ বিরোধী সাংসদদের উদ্দেশ্যে কৌতুক করে বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা এবং মেরঠ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ রাজেন্দ্র আগরওয়াল বলেন, ‘কালো পোশাকের অনেক ঝক্কি। ষাটের দশকে এই কালো পোশাক পরেই কলকাতা গিয়ে দর্শকদের হাতে প্রায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অভিনেতা দেব আনন্দ। এরকম কোনও অঘটন যেন না ঘটে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে।’ প্রবীন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘কার মন সাদা আর কার মন কালো, তা গোটা দেশ জানে। আমরা শুধু সরকারকে আয়না দেখানোর কাজ করছি।’ এইসবের মধ্যেই বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয় সংসদ৷ তাৎপর্যপূর্ণভাবে, শাসক-বিরোধী কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়েননি এদিন। বিরোধী বিক্ষোভে বিবাদমান সংসদে শাসক-বিরোধী অবস্থান নিয়ে টানটান স্নায়ুযুদ্ধ ছিল অব্যাহত৷ কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ বলেছেন, ‘আমরা বিশ্রাম নেব না যতক্ষণ না মণিপুর ইস্যু নিয়ে সংসদে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী। ততক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন জারি থাকবে।’