পারমিতা রায়, শিলিগুড়ি: সালটা ২০১৪, গরমের দুপুরে স্কুলের বাইরে বসে রাজগির সাহানি। সামনে রাখা থার্মোকলের বাক্সের নীচে বড় বরফের টুকরো। তার ওপর সাজানো চলতি কথায় যেগুলোকে বলে বরফ, পেপসি। নানা রঙের এবং নানা স্বাদের। এক, দুই থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দশ টাকা অবধি দাম। অধিকাংশ দিনই স্কুল ছুটির আগে বিক্রি হয়ে যেত সব। রাজগির যখন স্কুলের সামনে, সেইসময় পাড়ার মোড়ে এসে ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেন নরেশ দাস। সেই শব্দ শুনলে বাড়িতে আটকে রাখা যেত না ছোটদের।
কাট টু ২০২৪ সালের মে মাসের তপ্ত শহর। পাড়ার মোড়ে এসে এখনও ঘণ্টা বাজান নরেশ। এখন অবশ্য তাঁর কাছে বরফ-পেপসি পাওয়া যায় না। এয়ারকন্ডিশনড গাড়িতে বাটি, চকোলেট বার, কর্নেটো সহ বিভিন্ন ধরনের আইসক্রিম(Ice Cream) থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে গ্রাহকদের স্বাদ। পাল্লা দিয়ে পালটেছে ব্যবসার ধরন।
স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে ১-২ টাকার পেপসি, বরফ কেনার অভিজ্ঞতা কমবেশি অনেকের। এখন শিলিগুড়িতে(Siliguri) সেই দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্ম স্কুল ফিরতি পথে বায়না ধরে জুস কিংবা আইসক্রিম পার্লারে যাওয়ার। ইউনিফর্ম পরা নীচু ক্লাসের পড়ুয়াদের হাত ধরে বাবা কিংবা মা, উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের ভিড় জমে সেখানে।
মিল্কশেক, স্মুদি, লস্যি থেকে ফলের রস- বিকল্প প্রচুর। চাহিদাও তুঙ্গে। এই গরমে মাথা, মন ও পেটকে ঠান্ডা রাখতে পানীয়গুলো দেদারে বিকোচ্ছে। কারও পছন্দ ব্ল্যাক কারেন্ট শেক, আবার কেউ অর্ডার দিচ্ছেন বডি কুলার ড্রিংক। কিছুজনের পছন্দ চিরাচরিত নিম্বু পানি।
চড়া রোদে কাজে বেরিয়েছিলেন সুমন দত্ত, বিতান সাহারা। সূর্য যখন মধ্য গগনে, পাকুড়তলা মোড়ের এক জুস পার্লারে এসে দাঁড়ালেন দুজন। সুমনের পছন্দ বেলজিয়াম চকোলেট শেক আর বিতানের ম্যাঙ্গো ফালুদা। এক চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। এটা খেলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পেট ঠান্ডা থাকে।’
বদলে যাওয়া স্বাদের কথা মাথায় রেখে নতুন দোকান খুলেছেন সৌরভ সাহা। প্রধাননগরে তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ব্যবসা বেশ ভালোই হচ্ছে।’ ওই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী সমীরকুমার দত্ত জানালেন, গরমকালে সবমিলিয়ে রোজ গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্লাস বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকা থেকে শুরু ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম সেসবের। চাহিদা বেশি ম্যাঙ্গো, চকোলেট, স্ট্রবেরি এবং ওরিও শেকের। রমরমিয়ে বিকোচ্ছে ড্রাইফ্রুট লস্যি।
অনেকে আবার বাড়ি থেকে লস্যি, লেবুর শরবত বানিয়ে সাইকেলে করে শহর ঘুরে বিক্রি করছেন। সেখানে দাম শুরু ১০ টাকা থেকে। ভিড় রয়েছে আখের রস বিক্রির ঠ্যালাগাড়ির সামনেও।
তবে ভাটা পড়েছে সেই নস্টালজিক বরফ-পেপসির বিক্রিতে। নরেশ এবং রাজগির জানালেন, স্থানীয় কারখানায় তৈরি আইসক্রিমের কদরও খুব একটা নেই। নামীদামি ব্র্যান্ড ছাড়া অধিকাংশ মানুষ কিনতে চাইছেন না।
গোলু সাহানি নামে এক ব্যবসায়ীর কথা, ‘আগে স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা ছিল কম দামের বরফ-পেপসির। এখন তাদের স্বাদ বদলেছে। অভিভাবকরা খেতে দিতে চান না। স্বাভাবিকভাবে বিকিকিনি অনেকটা কম। তাই সংসার চালাতে অন্য কাজ করতে হয়।’
শহরে তেমন বিক্রি নেই বলে শহর সংলগ্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে বরফের সঙ্গে স্থানীয় স্তরে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি করেন অমরজিৎ সিং। আগে দিনে ১০০ পিস বরফ বিক্রি হত, এখন বরফ ও আইসক্রিম মিলিয়ে গড়ে ৪০ থেকে ৫০টা বেচেন। তাছাড়া যে এসি ভ্যানে রাখতে হয়, সেটা অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ। এই পরিস্থিতির কারণে বহু মানুষ পেশা বদলেছেন।
কিছু মানুষ অবশ্য স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে চান। এই যেমন বিশাল ঠাকুর। বললেন, ‘স্কুল ছুটির পর ১ টাকা দিয়ে পেপসি কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। এখন সেগুলো খুব একটা বিক্রি হয় না। চাহিদা নেই সেজন্য বোধহয়। তবু রাস্তায় গাড়িতে আইসক্রিম বিক্রি করতে দেখলে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, পেপসি আছে নাকি?’ একই কথা সুকমার রায়ের।