শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: মহানন্দার বিষাক্ত জল (Contaminated Water) শহরে সরবরাহ করে কাঠগড়ায় শিলিগুড়ির (Siliguri) মেয়র গৌতম দেব (Goutam Deb)। বৃহস্পতিবার পুরনিগমের সামনেই তাঁর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম। চোর চোর স্লোগান দিয়ে তাড়া করা হয় তাঁকে। কোনওরকমে মেয়র পারিষদ দুলাল দত্তের গাড়িতে উঠে এলাকা ছাড়েন তিনি। পুরনিগমের যে রিপোর্ট সামনে এসেছে তাতে মহানন্দার বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ২.৯। তাতেই গেল গেল রব উঠেছে সর্বত্র। তবে মহানন্দার দূষণ নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ্যে এনেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাতে আঁতকে উঠবেন যে কেউ। গবেষকরা বলছেন, মহানন্দার জলে (Mahananda River) কিলবিল করছে লক্ষ লক্ষ ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়া (Bad Bacteria)। খাওয়া বা স্নান তো বহু দূরের বিষয়, ওই জল স্পর্শ করা মানেই বিপদ ডেকে আনা।
দীর্ঘদিন থেকেই মহানন্দার দূষণ নিয়ে কাজ করছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (North Bengal University) বায়োটেকনলজির একদল গবেষক। সেই সূত্রেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর নদী থেকে জল সংগ্রহ করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান তাঁরা। চলতি মাসের ১৬ তারিখ মহানন্দা থেকে নমুনা হিসাবে জল সংগ্রহ করেছিলেন গবেষকরা। শিলিগুড়ি শহরের সূর্য সেন পার্ক লাগোয়া মেলার মাঠ এলাকা থেকেই মহানন্দার জল সংগ্রহ করা হয়েছিল। একইদিনে সকাল ৯.৩০ মিনিটে এবং বিকেল ৫টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষার পর দেখা গিয়েছে সকালে সংগ্রহ করা নমুনায় প্রতি মিলিলিটার জলে ৭৯ লক্ষ বায়বীয় ব্যাকটিরিয়া রয়েছে। যার মধ্যে ৩৮০০টি ‘সুপারবাগ’ (এমন ব্যাকটিরিয়া যা বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে সক্ষম) আছে। বিকেলে যে জল সংগ্রহ করা হয়েছিল তাতে ৫৪ লক্ষ বায়বীয় ব্যাকটিরিয়ার হদিস মিলেছে। তারমধ্যে ১২ হাজার ৩০০টি সুপারবাগ পাওয়া গিয়েছে।
সংগৃহীত নমুনায় আরও ভয়ংকর নানা তথ্য উঠে এসেছে। তবে এখনই সেসব প্রকাশ্যে আনতে চাইছেন না গবেষকরা। গবেষকদলের প্রধান এবং বায়োটেকনলজির বিভাগীয় প্রধান রণধীর চক্রবর্তীর কথায়, ‘মহানন্দার জল দূষণের সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় তিরিশ বছর ধরে মহানন্দার জল নিয়ে নানা ধরনের গবেষণার কাজ করছি। প্রত্যেকবারই ভয়ংকর যেসব তথ্য উঠে আসছে সেগুলি সত্যিই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। প্রশাসন, পুরনিগম তো বটেই, সমস্ত নাগরিক মহানন্দাকে দূষণমুক্ত করতে এগিয়ে না এলে ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ।’
গবেষকরা জানিয়েছেন, জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমার মূল কারণ বায়বীয় ব্যাকটিরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। আর দ্রবীভূত অক্সিজেন যত কমবে ততই সেই জলের দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকবে। তবে মহানন্দার জলে ইকোলাই ব্যাকটিরিয়ার পরিমাণ সবথেকে বেশি চিন্তা বাড়িয়েছে গবেষকদের। যে নদীর জল পরিস্রুত করে পানীয় জল হিসাবে সরবরাহ করা হচ্ছে সেই জলের ইকোলাই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে মত রণধীরের। ইকোলাইয়ের সংখ্যা জানার জন্য মিন প্রবাবল নাম্বার (এমপিএন) পরীক্ষা করা হয়। তাতে একশো মিলিলিটার জলে কত সংখ্যক ইকোলাই আছে সেটা জানা যায়। পানীয় জল হিসাবে সরবরাহ জলে এমপিএন শূন্য হওয়া উচিত। এমপিএন ১-১০ হলে অর্থাৎ একশো মিলিলিটার জলে ১-১০টি ইকোলাই থাকলে সেটাই যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এমপিএন ১১-১০০ হলে সেটা উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এবং ১০০-র বেশি হলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেই ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তথ্য বলছে, চলতি বছর এপ্রিল মাসে মহানন্দার জলের এমপিএন ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার। আর সেই মাসেই মহানন্দার ফিক্যাল কলিফর্ম অর্থাৎ মানুষের মল থেকে জলে মেশার ফলে পাওয়া ইকোলাইয়ের সংখ্যা ছিল ৫০০০০। এমপিএন ১ হলেই যে জল বিপদের কারণ হতে পারে সেই জলের এমপিএন ১ লক্ষ ১০ হাজার ছোঁয়ার পরও হুঁশ ফেরেনি কারও।