শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি : দার্জিলিং জেলার চম্পাসারির দক্ষিণ পলাশের দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোনোর সময়ই দূর থেকে নজরে পড়ছিল ওই ‘দ্বীপ’। মহানন্দা নদীর মধ্যে উঁচু সে চর এলাকাকে দ্বীপ বললে খুব একটা বেশি ভুল হবে না। শহর সংলগ্ন এলাকায় এমন দ্বীপ এল কোথা থেকে? আরও অবাক ব্যাপার, ওই চর এলাকা থেকে উঁকি দিচ্ছিল বাড়িঘরও। কী করে যাওয়া যায় ওই এলাকায়? খোঁজ করতে করতেই দেখা মিলল, একটি সাঁকোর। সে সাঁকোতে অবশ্য স্কুটারের চাকা তোলার মতন সাহস জুটল না। নালার ওপরের সেই সাঁকো ধরে হেঁটেই কোনওমতে ওই দ্বীপে ঢোকা গেল ।
তিনপাশে মহানন্দা নদীর জল। নদীর ওপাশে দেখা যাচ্ছে পুরনিগমের সংযোজিত (জলপাইগুড়ি জেলার) ৪২ ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড। আর একপাশে বড় নালা। সেই নালার ওপরেই রয়েছে যাওয়া-আসার একমাত্র নড়বড়ে ওই সাঁকোটি। ওই নালাও গিয়ে মিলেছে নদীর সঙ্গে। ভেতরে ঢুকতেই সে যেন আলাদা এক ভূখণ্ড। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট টিনের বাড়ি। পাকা বাড়ির সংখ্যাটা নিতান্তই কম। আগাছায় ভরে রয়েছে একাংশ। রাস্তা বলেও আলাদা কিছু নেই। এসবের মধ্যেই নজরে পড়ল তৃণমূলের পতাকা ও ব্যানার। ডাবগ্রাম-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই এলাকার নাম দ্বীপনগর । মাঝুয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১৯/১০ নম্বর বুথের অন্তর্গত এই এলাকা।
দ্বীপনগরে ঢোকার মুখেই কথা হচ্ছিল বছর ষাটের মাধবী বর্মনের সঙ্গে। বড় নালার এপারটা দার্জিলিং জেলার দক্ষিণ পলাশের আওতায় পড়ে। মাধবী দক্ষিণ পলাশের বাসিন্দা। দ্বীপনগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে বসতি গড়ে ওঠার কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। প্রথম দিকে তো এলাকার কিছু মানুষই ওখানে বাড়ি বানিয়ে থাকতেন। এখন তো বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন।’ কুড়ি বছর আগে ওই এলাকায় জনা পঞ্চাশেক বাসিন্দা ছিলেন। এখন সেই সংখ্যাটা বেড়ে ২০০০ হয়েছে। তাঁরা ভোট দেন মাঝুয়ায়।
কী করেন আপনারা? প্রশ্ন করতেই স্থানীয় বাসিন্দা মিলন বর্মন বললেন, ‘কাছের ঘাটে বালি-পাথর তোলার কাজ করি। তাছাড়া আর কী করব বলুন তো?’ মিলন এসেছেন ক্রান্তি থেকে। শুধু ক্রান্তিই নয়, সবুজ ঘাসে মোড়া এলাকায় ঘোরার ফাঁকে দেখা হল, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের বাসিন্দা মহম্মদ ইকবাল, পরেশ বর্মনদের সঙ্গে। হঠাত্ এই জায়গায় এলেন কেন? শহর শিলিগুড়িতে দিনমজুরির কাজ করতে যাওয়া পরেশরা বললেন, ‘শহরে কাজ করতে এসেছি। শহরে থাকার মতন ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই এখানে থাকা শুরু করেছি।’
বোঝা গেল, দ্বীপনগরের পরিচিতি ছড়িয়েছে অনেকটা দূরে। উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলারই দিনমজুরির কাজের সঙ্গে জড়িতদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘গরিবের থাকার জায়গা’ হিসেবে। মুসলিম অধ্যুষিত এই এলাকায় রয়েছে রাজবংশী, হিন্দিভাষী বাসিন্দারাও। এখানে স্কুল-কলেজ তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার। রাস্তা পর্যন্ত নেই। সাঁকো ভেঙে গেলে, নতুন সাঁকো না হওয়া পর্যন্ত ওই দ্বীপেই বন্দি থাকতে হয়।
এলাকাটি একসময় কোনও জেলার মানচিত্রেও ছিল না। তবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৭ সালে বর্তমান পঞ্চায়েত এলাকার আওতায় আসে। দ্বীপের বাসিন্দা মফিজুর ইসলাম বললেন, ‘পঞ্চায়েত হওয়ার আগে আমরা নিজেরাই সাঁকো বানাতাম। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে প্রতি বছর পঞ্চায়েত থেকেই সাঁকো বানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা আর কতদিন চলে? নতুন সাঁকো না হওয়া পর্যন্ত আমরাই মেরামত করে চলার উপযোগী করে রাখি।’
দ্বীপের চারদিকে সরকার থেকে বাঁধ দেওয়ায় বাড়ি ভেসে যাওয়ার ঘটনা আর ঘটে না। এলাকার নেত্রী তৃণমূলের প্রতিমা ঠাকুরের বক্তব্য, ‘মানচিত্রে জায়গা দেওয়া থেকে শুরু করে উন্নয়ন, জায়গাটিকে থাকার উপযোগী করছে তৃণমূল সরকারই। তাই এলাকায় তৃণমূল ছাড়া অন্য কেউ নেই।’ এদিকে বিজেপি-বামেদের অভিযোগ, ‘প্রতিমাই এলাকায় জবরদখল চালাচ্ছে।’
তবে এসবের মধ্যেই ভোটকে কেন্দ্র করে উৎসাহ বাড়ছে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে। বিনয় বর্মন, মহম্মদ আশরফরা তাই খোঁজ রাখছেন, সাঁকোটার কোনও ক্ষতি হল কি না। কারণ ওই সাঁকো ভেসে গেলে আর ভোট দেওয়ার জন্য মাঝুয়ায় যাওয়া হবে না।