এই সাতাশির প্রান্তে এসে আমাদের স্মৃতি এখন টাইম মেশিনে চড়ে বসে থাকে। তাকে বলি, ফিরে যাও যুগের পর যুগ পেরিয়ে, সবুজ জলের তলা থেকে ডুবুরির মতো তুলে আনো, ফেলে আসা ধনরত্ন- আরও স্মৃতি। সুখের স্মৃতি, দুঃখের স্মৃতি, আনন্দ-বিষাদের স্মৃতি। এক সঙ্গে দুই তো মিশে যায়। যা কিছু আনন্দের, দূরের বলে তাতে বিষাদের চিহ্ন লেগে থাকে।
পুব বাংলার দূর গ্রামের দোলের কথা দিয়েই শুরু করি। তা ছিল, একদিন-দু’দিন নয়, যতদূর মনে পড়ে, মোট চারদিনের। দোলের আগের রাতে হত চাঁচর উৎসব, আমরা বাংলা ভাষায় যাকে বলতাম ন্যাড়াপোড়া। কথাটা নাকি ‘ম্যাড়াপোড়া’। কিন্তু সেটা তো পুঁথির বিষয়। আমরা দেখতাম গ্রামের বাইরে প্রাকপূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় শস্যহীন ধানখেতে গ্রামের দাদারা খড়কুটো শুকনো ডালপালা জড়ো করে একটা বিশাল ঢিবি তৈরি করতেন তারপর তাতে আগুন লাগাতেন। আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠত। তার চারপাশে আমরা ছোটরা দাঁড়াতাম, বড়রা কেউ কেউ হাতে একটা কুলো ঝুলিয়ে একটা কাঠি দিয়ে তাতে বাজাতেন আর এই ছড়াটা আওড়াতেন, ‘বালা আসে বুলা যায়’ -মানে ভালো আসে আর ‘ভুলা’ (মানে কি ‘ভুল’ বা অনুচিত জিনিস?) বিদায় নেয়। পরে আমার মনে হয়েছে, ইংরেজি নিউ ইয়ার্স ইভের রাত বারোটায় খ্রিস্টানদের গির্জায় যে ঘণ্টা বাজে তাতে নাকি ‘Ringing out the Old, আর ringing in the New’ বলে একটা ব্যাপার হয়। পুরাতনকে বিদায়, নূতনের সংবর্ধনা- চাঁচর ওইরকম একটা ব্যাপার। পুরোনোকে, শুষ্ক, জীর্ণ যা কিছু সব পুড়িয়ে ছাই করে দাও। সূর্যের উত্তরায়ণে চলে আসার এই নাকি এক উৎসব, বাংলা আর ওডিশায় চালু আছে। তখন এসব কে জানত, আমরা আকাশস্পর্শী আগুনের শিখা জ্বলছে, ফুলকি উড়ে উড়ে নিবে যাচ্ছে, শেষ শীতের আমেজটুকু আগুনে সেঁকে, ধেই ধেই করে নাচতাম কুলোর পিটুনির তালে তালে।
দ্বিতীয় দিনে সত্যিকারের দোলপূর্ণিমা। আমাদের গ্রামে কাছাকাছি এক বৈষ্ণব আখড়ার মানুষ ভোরবেলা নগরকীর্তনে বেরিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙাতেন, ভালোই লাগত ওই সুরে ঘুম থেকে জাগতে। প্রথম দিন কিছুটা নিরিমিষ, মূলত আবিরখেলা। গুরুজনদের পায়ে আবির দেওয়া, গুরুজন দিতেন কপালে আবির। বৌদি শ্রেণিয়রা একটু বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে সারা গালে মুখে মাখিয়ে দিতেন আবির। দোল, মানে রাধাকৃষ্ণের দোল। আমাদের গ্রামে কোনও বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের একটি কুঞ্জ সাজানো হত, গাছপালা, রঙিন কাগজের মালা দিয়ে। তাতে একটি দোলনা ঝোলানো হত, তাতে রাধাকৃষ্ণের ছবি বা মূর্তি। তাতে পুজো তো হতই, তার প্রসাদ ছিল এক মস্ত আকর্ষণ আমাদের, কিন্তু ওই দোল উপলক্ষ্যেই গ্রামে তৈরি হয়ে যেত একটি অস্থায়ী কীর্তনের দল, খোল করতাল এমনকি হারমোনিয়াম সহ। আমরা কিছুদিন আগে থেকেই তাদের রিহার্সাল শুনতে ভিড় করতাম সন্ধ্যার পরে, অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে যতদূর পারা যায়। আমার সুবিধে ছিল যে, অনেক সময় রিহার্সালটা আমাদের বাড়িতেই হত। একটা গানের দুটো লাইন, কীর্তন ঠিক নয়, আমার মনে আছে- ‘মনোব্যথা কব কথা, কী করিবে প্রাণকানাই, আদরিণী রাধারানি বুঝে প্রাণে বেঁচে নাই।’ কথার দুঃখের সঙ্গে বেহাগের বেদনমূর্ছনা মিশেছিল বলে মনে আছে কি না জানি না।
সেই কীর্তনের দল সারা গ্রামে কীর্তন বা রাধাকৃষ্ণের গান গেয়ে সারা গ্রাম পরিক্রমা করত দোলের দিন সন্ধ্যায়, আমরা তার সঙ্গী হতাম। গ্রামে যত কুঞ্জ ছিল সবখানেই ‘হরির লুট’ হত কীর্তনের ধুম্বল-এর উত্তাল তালে, আমরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাতাসা কুড়িয়ে নিতাম মাটি থেকে। মনে আছে, সেদিন বাড়িতে নিরিমিষ রান্না হত, কখনও বা খিচুড়ি, প্রচুর ভাজাভুজি দিয়ে।
পরের দিন আসল হোলি। ওই দিন ছোটদের বাঁধভাঙা আনন্দের দিন। গোলা রঙের বালতি আর পিচকিরি হাতে আমরা বাড়ির সামনে রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়াতাম। আমাদের পরনে থাকত পুরোনো, কখনও একটু ছেঁড়াখোঁড়া, কিন্তু পরিষ্কার ধোয়া জামা। পথচলতি কুকুর বিড়াল গোরু থেকে যে মানুষ যেত তাদের কারও রেহাই ছিল না রং থেকে। পুব বাংলার গ্রাম, আমাদের বলা হত, অন্য ধর্মের মানুষদের রং দিও না, কিন্তু আমরা কি সবসময় তা মেনেছি। তাঁরাও হাসিমুখে সহ্য করেছেন আমাদের অনাচার। বেলা বাড়লে যখন মানুষ বিরল হয়ে আসত, কুকুর, বিড়াল দূর থেকে পালাত, সকলের জামাকাপড় টেকনিকালার ও ভিজে জবজবে, তখন আমরা বালতির রং-গোলা জল নিজেদের মাথায় ঢেলে চান করে সেদিনের মতো রং খেলা সাঙ্গ করতাম। তারপর রুদ্ধশ্বাসে সাবান মেখে পুকুরে ঝাঁপিয়ে বা কুয়োর বালতি বালতি জল ঢেলে রং তোলার পালা। কিন্তু কিছু দুর্ধর্ষ রং তো উঠতই না, রানি কালার না কী সব, ফলে মুখে নানারকম ছোপ নিয়েই ক’দিন ইশকুলটিশকুলে যেতে হত, শিক্ষকদের কাছে সলজ্জভাবে। সকলেই দেখে মনে মনে ভাবতেন, ‘বাবু রং খেলেছে বটে!’ উঠোনের কাপড় মেলবার তারে দু’-চারদিন বহুবর্ণ জামাকাপড় শুকোত। তারপর সেগুলো কোথায় লুকিয়ে পড়ত কে জানে?
চতুর্থ দিন হল কাদা-মাখামাখি খেলা, কাদা ছোড়াছুড়ি বলব কি না জানি না। ওটা মূলত বড়দের, ওতে আমাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। মূলত দাদা এবং তাদের বন্ধুদের। জানি না, এতে কী হত। উত্তর ভারতে দোলে একটা গালাগালির মহোৎসব হয়, রূপকার্থে কাদা ছোড়াছুড়ি- তার সঙ্গে এর কোনও যোগ আছে কি না। কিংবা গ্রিক দিয়োনুসস বা ডায়োনিসাসের উৎসবের। বড় হয়ে পড়াশোনা করে বুঝেছি যে, দোল জাতীয় উৎসবের জন্ম ধর্মের জন্মেরও আগে, তা কোনও কোনও ধর্মের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মাত্র। এ উৎসবে একটু আদিমতা আছে, অত্যাচারও আছে।
শহরে দোলের স্মৃতি সম্ভবত আরও উদ্দাম। যখন পশ্চিম বাংলার রেলওয়ে শহর খড়্গপুরে এলাম উদ্বাস্তু হয়ে তখন তার সঙ্গে যোগ হল অবাঙালি দোলের স্মৃতি। হিন্দি ছবির গানে উচ্চগ্রামে মাইক, মুখে রং ও আবির মাখা মস্তানদের মিছিল ও হুটোপুটি। পরে যখন কলকাতায় এলাম, ছাত্র হিসেবে- নিজেকে কেমন বহিরাগত লাগত, মেসের ছাদ থেকে পথে দোলের হইচই দেখতাম। মেঘের মতো গোলাপি বা লাল আবির উড়ত হাওয়ায়, দেখতে বেশ ভালো লাগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে দোলের আগের দিন একটু আবির আনত সহপাঠিনীরা, তা ছিল আমাদের জীবনে বসন্তকালের স্পর্শ। কেউ হয়তো গান ধরত ‘ওগো কিশোর আজি তোমার দ্বারে পরান মম জাগে।’
যাদবপুরে অধ্যাপনায় ঢোকার পর ছাত্রীরা একটু আবির দিত পায়ে। প্রণাম করত, সেটা বড় ভালো লাগত। তারপর থেকে পায়ে আবিরে অভ্যস্ত হয়ে আছি। যারা পায়ের বদলে মুখে মাথায় আবির দিত জোর করে, তাদের আর আমার জীবনে বসন্ত বহুদিন বিগত, কেউ কেউ তো শীতবসন্তের ওপারে চলে গিয়েছে। গায়ে তরল রং লাগলে সর্দিকাশি ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয় করবার বয়সে পৌঁছেছি অনেকদিন। যারা বসন্তে আছ, তাদের জন্য দোল অক্ষয় হোক।
(লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ)
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ অভিষেক শর্মাকে সঙ্গে নিয়ে ২২গজে ঝড় তুললেন ট্র্যাভিস হেড। ৬২ বল…
শিলিগুড়িঃ ওষুধের দোকানের ক্যাশবাক্স খুলে সব টাকা নিয়ে হাপিস হয়ে গেল রোগীর এক পরিজন। বুধবার…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পরীক্ষায় অঙ্কে ২০০-তে ২১২! বর্তমানে পরীক্ষায় কাড়ি কাড়ি নম্বর না পেলে…
রায়গঞ্জঃ রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এবারও বন্ধ থাকল রবীন্দ্র ভবন। ফলে রবীন্দ্র ভবনে রবীন্দ্র মূর্তিতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত বিশিষ্ট পরিচালক তথা সিনেমাটোগ্রাফার সংগীত শিবন (Sangeeth Sivan)। বুধবার মুম্বইয়ের…
গয়েরকাটা: দারিদ্রকে জয় করে উচ্চমাধ্যমিকে (HS Result 2024) নজরকাড়া সাফল্য জলপাইগুড়ির পুস্পিতা বিশ্বাসের। আংরাভাসা বংশীবদন…
This website uses cookies.