- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
দু’দিন আগে একটা খবর পড়ে চমকে যেতে হয়। ঠিকঠাক পড়ছি তো? এমনও হয় তা হলে?
ফ্রান্সে একটা বিশ্বখ্যাত সুপার মার্কেট চেইন রয়েছে। নাম কারফোর। ওয়ালমার্ট, অ্যামাজনের প্রতিদ্বন্দ্বী। তিরিশটার বেশি দেশে রয়েছে তাদের স্টোর। ফ্রান্সে বৃহস্পতিবার থেকে তাদের সব স্টোরে নোটিশ লাগিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে একটা তথ্য। আমরা আর পেপসিকোর কোনও ব্র্যান্ড বিক্রি করছি না।
কোন কোন ব্র্যান্ড? আপনারা সবাই চেনেন। পেপসি, সেভেন আপ, লেজ চিপস, মাউন্টেন ডিউ, গ্যাটোরেড, ট্রপিকানা, মিরিন্ডা, ডোরিটোস, কোয়াকার…।
কেন বিক্রি করবে না? নোটিশে কোনও লুকোছাপা নেই, স্পষ্ট করে বলা-এই ব্র্যান্ডগুলোর দাম অকারণ অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ানো হয়েছে। যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমরা এসব প্রোডাক্ট বিক্রি করব না।
শুধু ফ্রান্স নয়, ইতালি- স্পেন- বেলজিয়াম থেকে পেপসির প্রোডাক্ট সরিয়ে নিয়েছে কারফোর। ‘অকারণ’ দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে। কারফোরের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন ফ্রান্সের বৃহত্তম সুপার মার্কেট ই. লেকলার্কের চেয়ারম্যান নিজে।
কল্পনা করি, ভারতে কি এমন ঘটনা কোথাও ঘটবে? শুধু কল্পনাই থেকে যায়।
কল্পনা করি, পেপসির এই হেনস্তায় কি কোকা কোলার কর্তাদের মুখে হাসি ফুটবে? আমরা ভারতীয়রা একটা সময় কোক বনাম পেপসির অ্যামবুশ মার্কেটিংয়ের যুদ্ধ দেখে অবাক হয়েছিলাম। কয়েক হাজার টন নিউজপ্রিন্ট ও কালি খরচ হয়েছিল। তবে ঠিক এই খবরে কোকা কোলার উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই আদৌ। তারাও সমস্যায়। কোকা কোলা, নেসলে, ইউনিলিভার এবং প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল গত দু’বছরে তাদের জিনিসের দাম বাড়িয়েছে। তাদের ওপরও জনগণেশ খুশি নয়। সুপার মার্কেট চেইনগুলোও। রিটেলার এবং ব্র্যান্ডের লড়াইয়ে দু’পক্ষের সম্পর্ক একটা সময় এমন তিক্ত হয়ে যায়, অনেক নামী ব্র্যান্ডের জিনিস কিছুদিনের জন্য শপিং মল থেকে তুলে নেওয়া হয়।
গ্রসারির কথা ধরলে ইউরোপে সবচেয়ে বড় বাজার ফ্রান্সে। সেখানে সরকার বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে জিনিসপত্রের দাম কমানোর। চাপ বাড়াচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারার ও রিটেলারদের ওপর। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ বলেছেন, খাবারের জিনিসের দাম অন্তত ৫ শতাংশ কমাতে হবে।
ইউরোপে যা খবর, তাতে প্রচুর সংস্থা তাদের দাম প্রায় দশ শতাংশ বাড়িয়েছে। কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে দুটো জিনিসের। এক, উপাদানের দাম বেড়েছে। দুই, শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে গিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জনতার গর্জন, তারা নাকি বেশি দামে কম জিনিস বিক্রি করে লাভ করছে।
ফ্রান্স ছেড়ে ইউরোপের আরেক অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ ইংল্যান্ডে আসি। সেখানেও ছবিটা একরকম। লন্ডন প্রবাসী বন্ধুর কাছে শুনলাম, এবার বক্সিং ডে সেলের দিন মার্ক অ্যান্ড স্পেনসার বা নেক্সটের মতো চেন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। বক্সিং ডে সেলের দিকে এক বছর ধরে তাকিয়ে থাকেন ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ। সেদিন ভোর থেকে শুরু হয় লাইন- কে কত আগে স্টোরে ঢুকে পছন্দের জিনিস বেছে নেবে। আর সেদিনই কিনা সব পছন্দের মল বন্ধ।
কেন্টের ডাটফোর্ডে ব্লু ওয়াটার শপিং মল ইংল্যান্ডের পঞ্চম বৃহত্তম শপিং সেন্টার। এত বড় যে, ভালো করে ঘুরতে একদিন লেগে যায়। সেখানেও ভিড় ছিল না। অনেক দোকান ছিল বন্ধ। অক্সফোর্ডের কাছে বিস্তার ভিলেজ ডিজাইনার আউটলেটের জন্য বিখ্যাত। সেখানে একেবারে এক ছবি। লন্ডন প্রবাসী শিল্পপতি বঙ্গসন্তান ঘুরে এসে হিসেব দিলেন, ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিক্রি কমে গিয়েছে ভিলেজে।
এমন চূড়ান্ত দুরবস্থা ঠিক কেন? উত্তর একটাই-মুদ্রাস্ফীতি। কোভিডের ধাক্কা সামলাতে ব্রিটিশ সরকার নানা পদক্ষেপ করেছিল। অনেক ভরতুকির গল্প লুকিয়ে ছিল। তবে কতদিন শুধু ভরতুকি দিয়ে চলবে? কোভিডের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। সমস্যা তাতে পাহাড়প্রমাণ। কতদিন সরকার শুধুই আর্থিক সাহায্য করে যাবে? এখন সরকার বিভিন্নভাবে অর্থ তুলছে মানুষের কাছ থেকে। লন্ডনের হিথরো বা গ্যাটউইক বিমানবন্দরে আপাতত কাউকে নিতে বা ছাড়তে গেলে ৫ পাউন্ড করে কেটে নেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না।
পরে লিখতে ভুলে যেতে পারি। এখানেই জুড়ে দেওয়া যাক একটা তথ্য। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো গাজা যুদ্ধ কতটা প্রভাব ফেলেছে ইউরোপে। ইংল্যান্ডে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে একেবারে নতুন এক প্রবণতা। বিশেষ করে বার্মিংহ্যাম, নিউহ্যাম, টাওয়ার হ্যামলেটস, ব্র্যাডফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টারে। সেখানে মুসলিমদের অধিকাংশ দোকানে কোকা কোলা বা পেপসি জাতীয় কোনও আমেরিকান ব্র্যান্ড পাওয়া যাচ্ছে না। কেন রাখছেন না, জানতে চাইলে নিরামিষ জবাব পাবেন-‘এমনি এমনি। আসলে পাওয়া যাচ্ছে না।’ আপনি বহুদিনের চেনা ক্রেতা হলে উত্তর পাবেন, ‘গাজায় ইজরায়েলিদের আমেরিকা সাহায্য করছে। তাই আমেরিকার জিনিস আমরা রাখব না।’ মানে কার্যত অঘোষিত বয়কট। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রচুর বাংলা কাগজ বেরোয়। মালিক বাংলাদেশি। সেখানকার কাগজে এখন শুধুই গাজার খবর।
এখান থেকে একটু সরে এসে ১১৯ বছরের সংস্থা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স ফেডারেশনের নতুন প্রেসিডেন্টের কথা শোনাই আপনাদের। টেক্সটাইলের পরিস্থিতি শোনা যাবে। ভদ্রলোক ভারতীয়- কে ভি শ্রীনিবাসন। সংস্থার প্রধান দপ্তর সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে। টেক্সটাইলের পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের দায় এঁরই। শ্রীনিবাসনের হিসেবে, ২০২২ সাল থেকে টেক্সটাইল শিল্পে মারাত্মক দীর্ঘকালীন স্লোডাউন চলছে গোটা পৃথিবীতে। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে ২০২১-২০২২ সালে অনেক রিটেলার সংস্থা একটু বেশি দামের জিনিস তৈরি করেছিল। সেইসব জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে। কেউ কিনছে না।
এবার যে ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল, সেখানে ফিরে যাওয়া যাক প্রিয় পাঠক আমার। ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো দেখে রিটেলারদের প্রতিবাদ নিয়ে। মাস চারেক আগেই ফ্রান্সে কারফোরই একটা প্রচার চালু করেছিল। শ্রিঙ্কফ্লেশন নিয়ে। অবশ্যই শব্দটা ইনফ্লেশনকে অনুসরণ করে তৈরি। শব্দটা তৈরির কৃতিত্ব ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পিপা মালমগ্রেনের। ২০০৯ সালে তিনি শব্দটা চালু করেন খাবার এবং পানীয় ইন্ডাস্ট্রি প্রসঙ্গে। হয় এখানে দাম এক রেখে জিনিসের ওজন কমানো হবে, কিংবা মান খারাপ হবে। আবার কোথাও দাম বাড়িয়ে ওজন কমানো হবে, মানও খারাপ হবে।
এই জাতীয় অভিযোগেই সুইৎজারল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত লিন্ডট চকোলেট থেকে লিপটন আইস টি-অনেক ব্র্যান্ডকে সতর্ক করা হয়েছিল কারফোরের তরফে। ২৬টি জিনিসের ওপর নিজেরাই লাগিয়ে দিয়েছিল স্টিকার। কী অভিযোগ? তারা নাকি প্যাকেট ছোট করে দিয়েছে, অথচ বাড়িয়ে দিয়েছে দাম। যদিও কাঁচামালের দাম কম। এবার থেকে আমবাঙালিও চকোলেট বা চায়ের প্যাকেট কেনার আগে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখতে পারেন। ইউরোপেই যদি এই হয়, তা হলে ভারতে তো ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ হতেই পারে।
কারফোর যে ২৬ জিনিসে স্টিকার লাগিয়েছিল, তাতে হিসেব কী ছিল শুনিয়ে রাখি। স্টিকারে বলা ছিল, এই প্রোডাক্টগুলোতে ওজন বা ভলিউম কমানো হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানো হয়েছে।
উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে ব্যাপারটা। পেপসিকোর লিপটন চায়ের বোতলে ১.৫ লিটার থেকে ১.২৫ লিটার চা থাকছে। অথচ দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। নেসলের গুইগোজ ৯০০ গ্রাম থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩০ গ্রাম। ইউনিলিভারের ভিয়েনেত্তা আইসক্রিম কেক ৩৫০ গ্রাম থেকে হয়ে গিয়েছে ৩২০ গ্রাম। সুইস চকোলেটের ওপরেও পড়েছে এমন স্টিকার।
লিখতে লিখতে ভাবি, আমাদের দেশে এমন সাহসী রিটেলার কবে আসবে? যারা দোকানের সামনে সটান টাঙিয়ে দেবে নোটিশ—‘এই ব্র্যান্ডগুলোর দাম অকারণ অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ানো হয়েছে। যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমরা এসব প্রোডাক্ট বিক্রি করব না।’
স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন দেখে যাই।