- যোগেন্দ্র যাদব
কৃষকদের দাবিদাওয়ার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য (এমএসপি)। শেষ অবধি কংগ্রেস কৃষকদের এই দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের ফলাফল এবং আমাদের প্রজাতন্ত্রের ভাগ্য তর্কাতীতভাবে একটি প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে। তা হল, মোদি না মুদ্দা (ইস্যু)? এখনও পর্যন্ত আমরা শুধু মোদির প্রতিধ্বনি শুনছি যা একের পর এক মন্দির উদ্বোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এবার একটি মুদ্দা জনমানসে ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা চলাকালীন ছত্তিশগড়ের প্রান্তীয় শহর অম্বিকাপুরে যা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং ন্যায় যাত্রার পুরোধা রাহুল গান্ধি সেখানে এক বিরাট জনসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। রাহুল জানান, কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে স্বামীনাথন কমিশনের সূত্র মেনে কৃষকদের ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি গ্যারান্টির ব্যবস্থা করবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এই ঘোষণার আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কথা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকালীন বলেনি। এমনকি ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ইস্তাহারেও এমন প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি। ২০২২-এ রায়পুর প্রস্তাবে প্রথমবার কৃষকদের গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত দাবি মেনে নেওয়ার বার্তা দেয় কংগ্রেস। প্রথম কোনও জাতীয় দল কৃষকদের প্রাথমিক দাবির ৩টি প্রধান উপাদানকে আত্মস্থ করে। এক, এমএসপি নির্ধারণে স্বামীনাথনের সূত্র মেনে হওয়া উচিত। দুই, এটিকে আইনগত অধিকার হিসাবে গণ্য করতে হবে। শুধু প্রকল্প হিসাবে থেকে গেলে তার বাস্তবায়ন বর্তমান সরকার এবং তার কর্তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তিন, এই সুবিধা সব কৃষকের পাওয়া উচিত। যাঁরা এমএসপি’র আওতায় থাকা ২৩টি শস্যের চাষ করছেন, শুধু তাঁদের মধ্যে এই সুবিধা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।
দু’বছরের আপাত নীরবতার পর কৃষকরা ফের ময়দানে নেমেছেন। নিজেদের দাবিগুলি নিয়ে সরব হয়েছেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ভারত বনধের ডাক দিয়েছিল ‘আদি’ সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)। এই জোটে এখনও বেশ কয়েকটি বড় কৃষক সংগঠন রয়েছে। যেমন- যোগিন্দর সিং উগ্রাহান এবং রাকেশ টিকাইটের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন, কর্ণাটক রাজ্য রাইথা সংঘ, বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলি এবং পঞ্জাব ও হরিয়ানার বহু কৃষক সংগঠন। তবে কিছুদিন আগে সংযুক্ত কিষান মোর্চা (অরাজনৈতিক) বলে যে সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল তারা দিল্লি চলো অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আন্দোলনটি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
কৃষকদের দুই মঞ্চ হাত না মেলালেও সংযুক্ত কিষান মোর্চা (অরাজনৈতিক)-র নেতৃত্বে বিক্ষোভকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে হরিয়ানা পুলিশের পদক্ষেপের একযোগে নিন্দা করেছে সকলে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, দুই মঞ্চই কৃষকদের একই দাবি নিয়ে লড়াই চালাচ্ছে। স্বামীনাথন কমিশনের ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি গ্যারান্টি তাদের দাবি-তালিকার শীর্ষে রয়েছে। যে দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস গভীরভাবে নিজেদের যুক্ত করেছে।
২০২৪-এ এর গুরুত্ব কোথায়?
আমাদের কাছে কি এমন কোনও ইস্যু রয়েছে যা খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে? এমন একটি মুদ্দা যা মোদির সঙ্গে টক্কর নিতে পারে? সেভাবে নেই। এক রাজনৈতিক কর্মী কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনি ইস্যু নিজে থেকে তৈরি হয় না, তৈরি করতে হয়।’ কোনও বিষয়কে কার্যকর নির্বাচনি ইস্যুতে পরিণত করতে হলে ৬টি শর্ত পূরণের দরকার পড়ে। ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি স্বীকৃতির দাবিকে মান্যতা দিয়ে কংগ্রেস এই শর্তগুলির চারটি পূরণ করার আশ্বাস দিয়েছে। বাকি দুটি শর্ত নিয়ে আলোচনা চলছে।
প্রথম শর্তটি হল, ভোটারদের বড় অংশের কাছে নিজেদের দাবিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। যেমন কৃষকদের সিংহভাগ জানেন যে তাঁরা ফসলের উপযুক্ত দাম পান না। কমিশন অন অ্যাগ্রিকালচার কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি)-এর রিপোর্ট বলছে, নির্দিষ্ট কিছু ফসলের জন্য সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়কমূল্যের ফলে কৃষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই শুধু উপকৃত হয়। গম ও ধান বাদে খুব কম শস্যই সরকার ক্রয় করে। তাই ১৯৮০-র দশক থেকে শস্যের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ কৃষকদের মুখ্য দাবি হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় শর্ত, সমস্যার এমন একটি সমাধান খোঁজা জরুরি যা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি গ্যারান্টি সেই উদ্দেশ্যসাধন করে। এর ফলে কৃষকদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে সরকার দায়বদ্ধ থাকবে। ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের আইনি গ্যারান্টির দাবি কৃষকদের একজোট করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। এখানে একমাত্র অসুবিধা হল, অধিকাংশ কৃষক এখনও এই দাবির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে হওয়া আন্দোলনে সাফল্য মিললেও ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য ইস্যুতে এখনও স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। তবে ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে। এর সঙ্গে যে শুধু বড় কৃষকদের স্বার্থ জড়িয়ে নেই, সব শ্রেণির কৃষকের সম্পর্ক রয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। সবক’টি কৃষক সংগঠনের কাছে তিনটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমএসপি, স্বামীনাথন এবং আইনি গ্যারান্টি। কংগ্রেসের ঘোষণায় এই তিনটি শব্দের পাশে টিকচিহ্ন বসেছে।
তৃতীয় শর্ত হল, সমস্যাটি যেন অন্যপক্ষের কুক্ষিগত না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করা। এই সূত্রটি এমএসপি’র সঙ্গেও খাপ খায়। কারণ, মোদি সরকার এখনও এই ব্যাপারে কৃষকদের দাবিকে মান্যতা না দিয়ে নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছে। অথচ একসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি এমএসপিকে আইনি মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে চলা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
চতুর্থ শর্ত, উপযুক্ত সময় নির্ধারণ। কংগ্রেস ঠিক সময়ে কৃষকদের মুখ্য দাবিটিকে সমর্থন জানিয়েছে। নির্বাচনের আর দু’মাসও বাকি নেই। সরকারের পক্ষে এখনই সংশোধনী আনা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে এমএসপি আবার খবর হিসাবে জায়গা করে নিচ্ছে।
কাজ এখনও শেষ হয়নি এখনও দুটি শর্ত নিয়ে আলোচনা করা বাকি। এগুলি হল, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং রাজনৈতিক প্রচার। কংগ্রেসের ঘোষণা এখনও কৃষকদের কাছে পৌঁছোয়নি। মূলস্রোতের মিডিয়া কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষের কথা বলছে। কিন্তু কংগ্রেসের ঘোষণার উল্লেখ করছে না। কৃষকদের কাছে পৌঁছোতে হলে কংগ্রেসকে এই মিডিয়া অবরোধের দাওয়াই বার করতে হবে। সরকারের তরফে ইতিমধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রচার চলছে যে, এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টি সম্ভব নয়। এটা হলে সরকারি কোষাগার খালি হয়ে যাবে। এই তত্ত্ব পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমি এবং আমার সহকর্মীরা বিভিন্ন লেখায় শাসক শিবিরের দাবিগুলি খণ্ডন করেছি। কবিতা কুরুগান্তি দেখিয়েছেন, কীভাবে এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টি কার্যকর করা সম্ভব। এজন্য সরকারকে কখনোই সব ধরনের ফসল কিনে ভাঁড়ার ভর্তি করতে হবে না। এছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে হলে কৃষকদের জন্য জিডিপি’র এক শতাংশ ব্যয়কে রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় আনতে হবে।
এক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রধান সমস্যা হল, দলটি দীর্ঘদিন কৃষকদের মধ্যে তেমন একটা সক্রিয় হয়নি। কৃষক সংগঠনগুলি যাতে তাদের স্বাভাবিক বন্ধু হিসাবে গণ্য করে সেজন্য কংগ্রেসের তরফেও সক্রিয়তা জরুরি।
(লেখক সেফোলজিস্ট ও রাজনীতিক)