- ঋষি ঘোষ
কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো আর মালদার অধ্যাপক অমরচন্দ্র কর্মকার বা আবদুল ওহাবের মধ্যে একটা মিল আছে। ইংরেজিতে প্রথম উপন্যাস লেখার পর ধীরে ধীরে থিয়োঙ্গো ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর মাতৃভাষা গিকুয়ুর কাছে। উপনিবেশবাদী ভাষা কাঠামোকে ভেঙে এক নতুন বয়ান খুঁজেছিলেন তিনি। বাংলা বা ইংরেজিতে প্রাথমিক পর্যায়ে লেখালেখির পর এই দুজনও ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের মাতৃভাষার কাছে। শেরশাবাদিয়া বা খোট্টা ভাষায় কথ্যরূপের আগল ভেঙে গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা এবং অন্যান্য সৃজনশীল সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন তাঁরা। পৃথক ভাষা পরিষদ গঠনের স্বপ্ন আরও সাকার হয়ে ওঠে, যখন প্রতি বছর মালদা বইমেলায় শেরশাবাদিয়া বিকাশ পরিষদ, খোট্টা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ সমিতি, চাঁই সমাজ-এর স্টলে ভিড় জমান দর্শকরা।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার বিপন্নতার কথা ওঠে কিন্তু বাংলা ভাষার চাপে যে আঞ্চলিক কথ্যভাষাগুলি মরে যেতে বসেছে তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য হয় না। মালদা জেলার বিহার-বাংলা সীমান্তবর্তী এলাকার খোট্টা, চাঁই, শেরশাবাদিয়ার মতো কথ্যভাষার ক্ষেত্রে এই কথা নির্মমভাবে সত্যি। তা বাঁচাতে একের পর এক তৈরি একাধিক ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ সমিতি। মালদা বইমেলায় তাদের স্টল এবং সেখানে ভিড় প্রমাণ করে, বিরুদ্ধতারও একটা নিজস্ব বয়ান তৈরি।
মালদা জেলার মানিকচক, রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুর বা মোথাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রায় ১৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ খোট্টা ভাষায় কথা বলেন, এমনটাই দেখা গিয়েছিল এক ভাষাতাত্ত্বিক সমীক্ষায়। খোট্টা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ সমিতির দাবি, জেলার গ্রামীণ অঞ্চলের প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষই খোট্টাভাষী। ভাষাতত্ত্বের গবেষকরা আবার খোট্টার মধ্যে অঞ্চলভেদে দ্বারভাঙ্গিয়া খোট্টা, মৈথিলি খোট্টা, শেরশাবাদিয়া খোট্টা বা চাঁই খোট্টাকে চিহ্নিত করেছেন। শেরশাবাদিয়া বিকাশ পরিষদের গবেষকদের দাবি, মালদা এবং দুই দিনাজপুরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ এলাকার প্রায় ৬০ শতাংশ শেরশাবাদিয়া ভাষায় কথা বলে। সমস্যা ছিল, মৌখিক চেহারা থাকলেও লিখিত সাহিত্য ছিল না। বিগত দু’তিন বছরে মালদা বইমেলায় এই স্টলগুলিতে ক্রমবর্ধমান গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতার সংখ্যা প্রমাণ করে দেয় সেই অসম্পূর্ণতাটুকু রাখতে কেউ রাজি নন।
কেন এই আগ্রহ? কোনও ভাষাভিত্তিক সংগঠন তৈরি করে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন? রাজবংশীর মতো কোনও পৃথক ভাষা পরিষদ তৈরির মাধ্যমে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান নির্ভর গবেষণা? নাকি নিছকই নিজের শিকড়ের অনুসন্ধান? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতেই থাকে আর বিগত ৩-৪ বছরে এই ভাষার স্টলগুলির সামনে মিশ্র চরিত্রের ভিড়ও বাড়তে থাকে। বাংলা বা ইংরেজিতে না লিখে অধ্যাপক বা বুদ্ধিজীবীদের একাংশ লিখিত সাহিত্যের সম্ভার বাড়ানোর পেছনে মনোযোগী হতে থাকেন। তাঁদের অ্যাকাডেমিক ইনটিউশন বুঝিয়ে দেয়-লিখিত সাহিত্য না থাকলে কোনও ভাষা কখনও সামগ্রিক মর্যাদা পায় না, তাই কথ্যভাষার বন্ধন ভাঙতেই হবে।
কবি পতিতপাবন চৌধুরী বলছিলেন একটি পরিবারের কথা, যেখানে পরিবারের খুদেটি খোট্টায় কথা বললে বাবা একের পর এক থাপ্পড় মেরে বাংলায় কথা বলতে বাধ্য করেন। খোট্টা ভাষা নিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচডি করা মানুষ বুঝতে পারেন না, ‘ভাষা শিখব, বই লিখব’ থিমের প্রবল ঢক্কানিনাদের আড়ালে কোথায় হারিয়ে যায় ওই থাপ্পড়ের শব্দ!
(লেখক মালদার বাসিন্দা। কলেজ শিক্ষক)