- উত্তম সেনগুপ্ত
মৃত্যুর ৩৬ বছর পর মিলল ‘ভারতরত্ন’ সম্মান। এমন একটা সময় তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হল, যখন লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুরকে এই সম্মান দেওয়ায় দেশের রাজনীতি মহলে কথা উঠছে, এই সম্মান প্রদান আদতে সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।র
কর্পূরী ঠাকুর শুধুমাত্র একজন অসাধারণ জননেতাই নন, তিনি সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা নেতা ছিলেন। বেশ কিছু সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ১৯৭১ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম বার্ধক্য ভাতা চালু করেছিলেন। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মণ্ডল কমিশন তৈরির প্রায় ২০ বছর আগে কর্পূরী সরকারই ১৯৭১ সালে মহিলা, উচ্চবর্ণ ছাড়াও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য মুঙ্গেরি লাল কমিশনের সুপারিশে সংরক্ষণ ফর্মুলা কার্যকর করেছিল।
শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালে তিনি রাজ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা শুরু করেন। যাঁদের খুব অল্প জমি, তাঁদের উপর সারচার্জও তিনিই কমিয়েছিলেন।
রাজ্যের দু’বার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কর্পূরী। কখনোই পুরো মেয়াদ কাজ শেষ করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর প্রথম মেয়াদ ছিল প্রায় তিন বছর। আর দ্বিতীয়বার কাটিয়েছেন দুই বছর ছয় মাস। যদিও এই অল্প সময় তাঁকে বা তাঁর কাজের মানকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি।
কর্পূরী ছিলেন একজন কাজ পাগল অস্থির কর্মকুশলী। বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেতা হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি ১৯৮৮ সালে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে স্বল্প অসুস্থতায় হঠাৎই প্রয়াত হন। সেসময় তিনি ছিলেন বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। প্রবীণদের হয়তো মনে আছে, কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিন্দেশ্বরী দুবে আমলাদের যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁকে জানানো বাধ্যতামূলক বলে নির্দেশ জারি করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই কর্পূরী সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। তিনি সে সময় আমলাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে কাজ করবেন, তারপর প্রয়োজনে তাঁকে জানাবেন। আমলাদের উপর তিনি এতটাই আস্থা রাখতেন।
তাঁকে নিয়ে বহু জল্পনা ছড়িয়ে। কর্পূরী সম্পর্কে বিহারের সে সময়ের বেশ কয়েকজন বিধায়ক বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বেতনই পেতেন। তবু তাঁকে প্রায়ই বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হত। তিনি খুবই স্বল্প চাহিদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি খুব কম সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ১৯৭৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী তিনি। ওই সময় তাঁকে প্রায়শই পাটনার রাজপথে সাইকেল রিকশায় চলাফেরা করতে দেখা যেত। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের পাটনায় নিজের সঙ্গে সরকারি আবাসনে থাকতে দেননি। মনে করতেন, তাহলে সন্তানরা তাঁর রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে। এজন্য তিনি তাঁদের তাঁর সঙ্গে থাকার অনুমতি দেননি। এমনকি, পরিবারের কাউকেই সঙ্গে রাখতেন না। নিজের ইমেজ সম্পর্কে তিনি যে যথেষ্ট সচেতন থাকতেন, এই সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ।
বিরোধী দলনেতা হিসেবে তাঁর চালক সহ একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ছিল। আশির দশক বিহারে উত্তাল সময়। তখন লোরিক সেনা, রণবীর সেনা, ব্রহ্মর্ষি সেনা ইত্যাদি নানা বর্ণের সেনা প্রায়ই রাতবিরেতে গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাত। শুধু তাই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী বর্ণ গোষ্ঠীর গ্রামবাসীদের গণহত্যা করত। দলিতদের প্রায়ই সন্দেহ করা হত। মনে করা হত, তাঁরা নকশালদের সঙ্গে মিশছেন এবং তাঁরা বা তাঁদের পরিবার প্রায়ই ওইসব সেনার শিকার হচ্ছেন। নকশালরাও প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে থাকত। কখনো-কখনো একটি গ্রামের প্রায় সমস্ত মানুষকে খুন করত।
যেমন ঔরঙ্গাবাদের দালেলচক গ্রামে নকশালরা প্রতিশোধের অভিযান চালিয়ে এক রাতে প্রায় ৫৭ জন গ্রামবাসীকে খুন করেছিল। ভোরের অনেক আগে অপরাধীরা অদৃশ্য হয়ে যেত। প্রায়শই এমন গণহত্যার কয়েক ঘণ্টা পর রাজ্যের রাজধানীতে খবর এসে পৌঁছোত।
খুব একটা বেশি না হলেও এমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে কর্পূরী সবার আগে হাজির হয়ে যেতেন। কখনো-কখনো পুলিশের আগেও তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতেন। তিনি কীভাবে গভীর রাতে সামান্য কয়েকটি ল্যান্ডলাইন ফোনে যাবতীয় তথ্য পেয়ে যেতেন তা আজও একটি রহস্য। পাটনার সাংবাদিক মহল এমন গণহত্যা পরবর্তী খবর তাঁর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারতেন। কেউ কিছু জানার আগে তিনি সব কাজ মিটিয়ে প্রায় রাত দুটো নাগাদ অত্যন্ত গোপনে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিতেন। বেহাল রাস্তায় ওই রাতে পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে খুব ভোরে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতেন।
সেই দিনগুলিতে অবশ্যই কোনও মোবাইল ফোন ছিল না। বিরোধী দলের নেতা হিসাবে প্রায়শই তথ্যের প্রথম বেসরকারি নির্ভরযোগ্য উত্স হতেন কর্পূরী। প্রায়শই ঘটনাস্থল থেকে বিকাল পাঁচটার মধ্যে শহরে ফিরে আসতেন। পাটনায় ফিরেই ফ্রেজার রোডে সংবাদ সংস্থা ইউএনআই-এর অফিসে পৌঁছে যেতেন। সেখানে কার্যত প্রথম ব্যক্তি হিসাবে গোটা ঘটনার কথা লিখে ফেলতেন। যা পরে েফাটোকপি করে গোটা দেশের নানা সংবাদপত্র কার্যালয় সহ অন্যান্য সংস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হত।
তিনি একজন স্বনির্মিত স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনিই প্রথম মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রবলভাবে গলা ফাটিয়েছিলেন। রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধ করার জন্য আজও অনেকে তাঁকে দায়ী করেন। খুব স্বল্পকালের শিক্ষামন্ত্রী ও পরে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে খুব সংক্ষিপ্ত কার্যকালে তাঁর করা নানা কাজ পরবর্তীতে সংস্কারের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু কোনও কারণে তা থমকে যায়।
তিনি একাধারে উদ্যমী পাঠক। বিধানসভার মেঝেতে তাঁর ডেস্কে সবসময় রেফারেন্সের জন্য মার্কার, ফাইল, রিপোর্ট সহ নানা বইপত্র রাখা থাকত। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি কোনও ইন্টারনেট ছাড়াই হোমওয়ার্ক করতেন। বিধানসভা অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রস্তুতি নিতেন। তাঁর বক্তৃতাগুলি প্রায়শই সংসদীয় নিয়ম, অনুশীলনের রেফারেন্স দিয়ে তৈরি করা হত। কারণ, বিরোধী দলনেতা হিসাবে তিনি সরকারকে নিরলসভাবে আক্রমণ শানাতেন। বিরোধী দলের নেতা হিসাবে তাঁর উত্তরসূরি মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব কর্পূরীর বেশ কিছু অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু হোমওয়ার্কের জন্য তাঁর ধৈর্য, বিশদ বিবরণের জন্য তাঁর সেই চোখ ছিল না।
কর্পূরী সম্পর্কে অনেক উপাখ্যানের মধ্যে একটি বহুলচর্চিত ঘটনা বলি। একবার খুব বিরক্ত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই জনতা পার্টির এক প্রতিনিধিদলকে বলেছিলেন যে, জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধিই যখন কর্পূরীজিকে খুঁজে পাননি, তখন তিনি কীভাবে পারেন? আসল ঘটনা হল, জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতেই কর্পূরী ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’ হয়ে যান। সে সময় তিনি নেপালে চলে যান। ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়ভাবে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
শীতের মাঝামাঝি এক রাতের আরও একটি কাহিনী শোনা যায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শোয়ার ঘরে সিলিং ফ্যানটি ছিল প্রচণ্ড বড়। হাওয়াও ছিল ঝড়ের মতো। একদিন তিনি রাতভর সেই পাখা চালিয়ে শুয়েছিলেন। পরের দিন সকালে বিষয়টি জানাজানি হতে মুখ্যমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, রাতভর তিনি কোনও মশারি খুঁজে পাননি। তাই মশাদের দূরে রাখতে তিনি পাখা চালিয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন।
লালুপ্রসাদ ও নীতীশকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি তৈরির আগেই তিনি হঠাৎই প্রয়াত হন। যদিও ওই দুই নেতা নিজ নিজ কার্যকালে কর্পূরীর অনেক ধ্যানধারণাই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন বলে অনেকেই মনে করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কর্পূরী ঠাকুরকে সত্যিই ভোলা খুব কঠিন।
(লেখক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন রেসিডেন্ট এডিটর)