রূপায়ণ ভট্টাচার্য
কোচবিহারে ফাঁসিরঘাটে তোর্ষার বাঁশের সাঁকো দিয়ে জীবনে প্রথমবার হাঁটতে গিয়ে একটু অস্বস্তি হয় শুরুতে। যাব? কিছু হবে না তো?
আপনি দেখলেন, উলটো দিক থেকে একটা বাইকের উদয় সাঁকোর ওপর দিয়ে। পাশ দিয়ে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা টোটো। যাবে ওপারে।
আপনি যেতে থাকলেন টলোমলো পায়ে শিশুর মতো। ব্রিজের মাঝে মাঝেই ফাঁক। বাঁশগুলো সরে গিয়েছে মাঝে মাঝে। নীচ দিয়ে অদম্য গতিতে বয়ে যাচ্ছে তোর্ষার স্রোত। ঢেউ উপস্থিত সামান্য হলেও। অস্বস্তি হলে দু’দিকে জলধারায় তাকাতে নেই। শুধু সামনে তাকাতে হয়। এ সেতুর সুবিধে হল, দু’দিকেই বাঁশ দিয়ে দেওয়ালের মতো করা। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। অন্য ছোট সাঁকোতে কিন্তু ব্যালেন্সের খেলাও রয়ে যায়। ব্যালেন্স করতে করতে এগোতে হয়।
জীবন মানেও তো ওই ভারসাম্য রেখে যাওয়া, তাই না?
বর্ষা এলে নতুন করে উপলব্ধি হয়, আমাদের রাজ্যে কত সাঁকো চারদিকে। সাঁকো বলতে সাধারণত বাঁশের সাঁকোই বলা হয়। মাঝে মাঝেই খবর আসে সাঁকো ভেসে গিয়েছে। চার-পাঁচ লাইনের খবর- এসবে বোঝা যায় না, মানুষের যন্ত্রণা কত ভয়ংকর। ৫০০ মিটার দূরত্বের জন্য মানুষকে ঘুরে যেতে হচ্ছে হয়তো ১০ কিলোমিটার। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা টোটোয়, কিছুটা বাসে। তরুণ হলে তবু ঠিক আছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথা ভাবলে খুব কষ্ট।
কোচবিহার শহর লাগোয়া শুকটাবাড়ি, ভেলাডাঙ্গা বা টাপুরহাট বাজারের বাসিন্দাদের কথা ভাবা যাক। এই আষাঢ়-শ্রাবণে বাঁশের সাঁকো ভেঙে গেলে ১৩.৬ কিলোমিটার উজিয়ে আসতে হবে ফাঁসিরঘাটে। ওই বাঁশের ব্রিজটি থাকলে বড়জোর এক কিলোমিটার। কোচবিহার শহরেই যদি বছরের পর বছর সাঁকো থেকে যায়, সেতু আর হয় না, তখন গ্রামের দিকে কী হবে? কল্পনা করতে থাকি, যখন জল বেড়ে গিয়ে গ্রামীণ সাঁকোটি ভেসে যায় প্রতিবার, তখন দু’পাশের লোকজনের চোখমুখের অবস্থা কী রকম দাঁড়াতে পারে।
গত কয়েকদিনে কত জায়গার সাঁকোর কথা যে শুনলাম! সবই বেদনা জাগানো খবর। সাঁকো শব্দটি শুনতে রোমান্টিক, তবে বাস্তবে তত রোমান্টিসিজম আনে না। রূঢ় বাস্তবের সাঁকো। বাঁশের নড়বড়ে সাঁকোগুলো উপেক্ষার গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোনওমতে। এখন তো সবে আষাঢ়ের মধ্যবর্তী সময়। আরও কী ভয়ংকর অপেক্ষা করছে ভরা শ্রাবণে।
কিছু সাঁকোর কথা শোনানো যাক।
তুফানগঞ্জ মণিরঘাট এলাকায় রায়ডাক নদীর উপর বাঁশের সাঁকো। যা দিয়েই কুটিবাড়ি, বাঁশরাজা, হরিরহাট, মান্তানি কালীবাড়ি, বক্সিরহাটের বহু মানুষ তুফানগঞ্জ যাতায়াত করে থাকেন। জল বাড়লে সাঁকো ভেসে যায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যোগাযোগ।
রায়ডাক নদীর কথা হল। এবার আত্রেয়ী নদীর বাঁশের সাঁকোর কথা শুনি। ডাঙ্গা পঞ্চায়েতের রঘুনাথপুর থেকে বান্ধবীকে নিয়ে কালিকাপুর যাচ্ছিলেন তন্ময় ঘোষ। বালুরঘাটের রঘুনাথপুর এলাকার ছেলে। পা পিছলে দুজনেই সাঁকো থেকে পড়ে যান। বান্ধবীকে বাঁচানো গেলেও তন্ময়কে বাঁচানো যায়নি। এই সাঁকোয় কান্না আছে যেমন, তেমন ক্ষোভ। সাঁকো হেঁটে পেরোতেই পাঁচ টাকা লাগে। মাঝে মাঝেই সেই অঙ্ক গিয়ে দাঁড়ায় দশ টাকা, পনেরো টাকা।
অনেক সাঁকো পেরোতেও কড়ি গুনতে হয় আজও। এবং সাঁকোর কথা উঠলে কতরকম নদীর নাম শোনা যায়। অতিচেনা তোর্ষাই তো কতরকম! তোর্ষা, শীলতোর্ষা, চরতোর্ষা, বুড়িতোর্ষা, মরাতোর্ষা। সুই নদীর নাম শুনেছেন? মালদার চাঁচলে মাধাইহাট ঘাট। তার একদিকে মাদাইহাট, অন্যদিকে হোসেনপুর। প্রতিবার ভোটের সময় সব পার্টির নেতারা এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, এই এবার পাকা সেতু হল বলে! আপনারা ভোটটা শুধু আমাদের পার্টিকে দিন। ভোট যায়, দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়- পাকা সেতু আর হয় না। কাগজে কত জায়গা সম্পর্কে খবরের শিরোনাম এক হয়ে যায় বছরের পর বছর- সাঁকোর দাবিতে ক্ষোভ বাসিন্দাদের।
চালসার কাছে রয়েছে ইনডং নদী। মানুষকে এপার-ওপার করতে হয় হাঁটু পর্যন্ত জল ভেঙে। গত অক্টোবরে এলাকার মানুষ নিজেরাই একটা বাঁশের সাঁকো বানিয়েছিলেন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে। একদিন হল কী, একদল হাতি এলাকার ধানখেত নষ্ট করে যাওয়ার সময় সাঁকোও ভেঙে চলে গেল। সব পরিশ্রম মাটি।
সাঁকো মানে গরম, শরৎ, শীত ও বসন্তে নিশ্চিন্তে যাওয়া। বর্ষা এলেই যত সমস্যা। মালদার সামসির কাছে একটা নদীর নাম ভাট নদী। লকড়িগোলা ঘাটের কাছে আবার সেই বাঁশের সাঁকো। কাছেই রতুয়া। সেখানে মহানন্দার ধারে শ্রীপুরের রানিনগর শ্মশানঘাট। সেখানে এতদিনেও পাকা সেতু হয়নি। সেই পুরোনো গল্প। ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি এবং ভোটের শেষে চোখ বন্ধ করে যাওয়া।
কোথাও কোথাও এই নড়বড়ে সাঁকো এত মহার্ঘ, একবার ভেঙে গেলে মুশকিল। আর ঠিক হবে না। হলদিবাড়ির রাঙ্গাপানির কাছে একটা সাঁকো ছিল বুড়িতিস্তা নদীর ওপর। একবার ভেঙে গেলে আর ঠিক হয়নি সেটা। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ঠান্ডায় নদী পেরিয়ে যেতে হয় প্রবল শীতে। হাঁটুজলের নদী, তবু তো ঠান্ডা। ক’দিন আগে বুড়িতিস্তারই খবর এল। হলদিবাড়ির বাজে জমজমায় বুড়িতিস্তার সাঁকো ভেসে গিয়েছে জলের তোড়ে। লোকে নদী পারাপার করছে থার্মোকলের ভেলায়। কেউ কেউ কলার ভেলায়। হলদিবাড়ির ওখানেই একটি নদী রয়েছে কাউয়াসুতি নামে। সেখানেও দিনকয়েক আগে সাঁকোটি গিয়েছে ভেসে। জলবন্দি প্রচুর।
বুড়ি বা মরা বিশেষণের অনেক নদী ধানখেত থেকে নদী হয়ে ওঠে এসময়। দিনকয়েক আগে মাথাভাঙ্গার মরা সুটুঙ্গাও যেমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল বৃষ্টিতে। শিকারপুরের বড়দোলা অঞ্চলে সাঁকোর একদিকে কচুরিপানা আটকে জলের ভারে ডুবে রইল সাঁকোর একটা দিক। কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত।
এমন সাঁকো সীমান্তের কাছে হলে আরও সমস্যা। মেখলিগঞ্জের জামালদহ গ্রাম পঞ্চায়েতে জায়গাটার নাম ২১০ দেবোত্তর বুড়াবুড়ি। সাঁকো ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। সেটা ভাঙায় গ্রাম কার্যত জলবন্দি।
বছর আটেক আগে উত্তর চব্বিশ পরগনায় ইছামতী নদীর ওপর এক বাঁশের সাঁকো দিয়ে যেতে যেতে স্বরূপনগরের ঘোলা গ্রামের এক কিশোরী উলটে পড়েছিল। ক্লাস এইটের ছাত্রী। বইটই ভিজে একাকার। কেঁদে ফেলেছিল হাপুস নয়নে। জানা হয়নি, সেই গ্রাম এখনও সেভাবে পড়ে রয়েছে কি না। একটা তো গ্রাম নয়, এমন শয়ে-শয়ে গ্রাম রয়ে গিয়েছে আজও। বাংলায়। গোটা দেশেই।
সাঁকো এবং সেতুর মধ্যে ফারাক ঠিক কোথায়, প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া কঠিন এমনিতে। সংসদ অভিধানে সাঁকো ও সেতুর মধ্যে ফারাক রাখা হয়নি। তবে সাঁকো খুব কাছের একটা জিনিস কল্পনায় ঘোরে, যা অনেক নিজের, অনেক কাছের। মনে হয়, সেতুতে লোক থাকবে বেশি, যানবাহন বেশি। সাঁকো সেখানে লাজুক অন্তর্মুখী কোনও কিশোরী। সাঁকোর মধ্যে যেমন অন্তরঙ্গতা মাখা, তেমন জেগে থাকে এক নির্জনতা। সাঁকো যেমন ভরসা দেয়, তেমনই ডেকে আনতে পারে বিপদ। সেতুতে সেই আচমকা বিপদ কম। যদিও কয়েকদিন ধরে বিহারে পরপর সেতু বিপর্যয় দেখাল, মাঝে মাঝে সেতু ও সাঁকোর ফারাকের সীমারেখা কীভাবে মুছে যায়।
কোচবিহারের তোর্ষার বাঁশের সাঁকো প্রতিবার বর্ষায় ভেসে যায়, আবার নতুন তৈরি হয়। দু’পারের বাসিন্দারা অধীর প্রতীক্ষায় থাকেন, কবে জুড়বে পথ। নদী একটু বড় হলে, বর্ষা প্রলম্বিত হলে এই বিপদ। দুর্গাপুজোয় হয়তো এপার ভরে যাচ্ছে আলোয় আলোয়। ওপার থেকে প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রবীণ দম্পতি, কিশোর-কিশোরীর এপারে ঠাকুর দেখতে আসার ইচ্ছে খুব। তা আর পূরণ হচ্ছে না। এত ঘুরে ঘুরে যাতায়াত সমস্যা তখন। তার চেয়ে গ্রামের মায়ামাখা অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকি গো।
একটি সাঁকো তৈরি মানে বহু ইচ্ছেপূরণের গল্প। সাঁকো সাক্ষী রয়ে যায় অসংখ্য প্রেম, প্রত্যাখ্যানের স্মৃতির। প্রতিটি সাঁকোয়, প্রতিটি নদী পারের কষ্টের মাঝে লুকিয়ে বহু লড়াইয়েরও গল্প। ফালাকাটার কাছে পলাশবাড়ির বাসিন্দা এক টাকার ডাক্তার বলে পরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামী শম্ভু পালের কথাই ধরা যাক। দিনের পর দিন ভদ্রলোক ঘুরে বেড়াতেন শীলতোর্ষায় নদী জোড়ার আর্জি নিয়ে। এ দুয়ার থেকে ও দুয়ার গিয়েছেন। মার খেয়েছেন পুলিশের হাতে। দমেননি। মৃত্যুর আগে দেখে গিয়েছেন নদী জুড়েছে। অস্থায়ী সাঁকোর বদলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এক স্থায়ী সেতু। কেউ তা মনে রাখে, কারও মনে রাখার সময় থাকে না। কেউ নদী সংযোগ দেখে যেতে পারেন, কেউ পারেন না। থেকে যায় রূঢ় বাস্তবের সাঁকো।
প্রতিবার বর্ষা এলে ঘনিয়ে আসে সাঁকোর মৃত্যুধ্বনি, শেষযাত্রার সংকেত। ভেসে যায়, ভেসে যেতে থাকে মন্ত্রী-নেতা-আমলাদের প্রতিশ্রুতি। নদী ও চরে বাতাস মেখে ঘুরে বেড়ায় হাজার হাজার মানুষের গভীরতম দীর্ঘশ্বাস।