- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের ওয়েবসাইটগুলোয় খবর খুঁজতে খুঁজতে চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়। দেখলাম, ঢাকা হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছেন দুই বেঞ্চের তিন বিচারপতি। ভাষা মাসের প্রথম দিনে ভাষা শহিদদের সম্মান জানাতে।
বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর এক দেবোত্তর সম্পত্তি মামলায় বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করেন দুপুর এগারোটায়। শেষ হয় দুপুর একটায়।
বাংলা ভাষা যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশিরাই বাঁচিয়ে রাখবেন, এপারের বাঙালিরা নন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। এই ফেব্রুয়ারি তা আর একবার বোঝাচ্ছে। ঢাকায় পুরো মাসজুড়েই চলবে অমর একুশের বইমেলা। আমাদের কলকাতায় এখন প্যান্ডেল খোলার শব্দ মিশে যায় বিষাদে। যে জায়গায় তরুণ-তরুণী দল লাইন দিয়ে দাঁড়াত দিন দুই আগে, এখন সেখানে বিষণ্ণতার বাঁশ এবং কাঠের স্তূপ পড়ে।
মেলায় যেসব বই ভালো লাগলেও কেনা হয়নি, সেগুলো এখন কোথায় পাব? শহরের বড় বড় বইয়ের দোকানে সেইসব বাংলা বই পাব না। সবকিছু চাপা পড়ে থাকবে ইংরেজি বইয়ের তাকে। তখন মনে জাগবে এক প্রশ্ন, যার কোনও উত্তর নেই, উত্তর হয় না।
এই যে বইমেলার সময় বাংলা বইয়ের অসংখ্য প্রকাশক দেখলাম, তাঁদের প্রকাশিত বই কোথায়? তাঁরা কি বইগুলো সব নিজের বাড়ি রেখে দিয়ে সেখান থেকে মার্কেটিংয়ে বিশ্বাসী? এই বাংলাকে আমরা বাড়িতেই রেখে দিলাম। কলেজ স্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের দোকানও আমরা নিঃশব্দে তুলে দিয়েছি কয়েক বছর হল। মফসসল শহরেও নোটস আর সাজেশনসের ভিড়ে আর সারাবছর বিক্রি হয় না বাংলা বই।
বাংলা ভাষা নিয়ে লিখতে লিখতে আরও কিছু কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে অস্তমিত বাঙালিয়ানার কথা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে রুদ্রপলাশ বা কাঞ্চনের দল হাসতে থাকে চারপাশে। রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়াও এসে যাবে ক’দিনের মধ্যে। দিন দশেকের মধ্যেই বসন্ত নিয়ে অজস্র উৎসব হবে বাংলার পাড়ায়, স্কুলে। বসন্ত মাখা রবীন্দ্রসংগীতের ডালি উপচে পড়বে, নিশ্চিত থাকতে পারেন। এখানেই প্রশ্ন, বসন্ত আসছে যাবতীয় উপচার নিয়ে, তবে বহ্নিমান বাঙালিয়ানা কি আর ফিরবে? নাকি বহ্বাড়ম্বরে ডুবে গিয়েছে বাঙালিয়ানা? বহ্নিমান ও বহ্বাড়ম্বর দুটো শব্দ বাংলা অভিধানে পরপর থাকে প্রায়ই। দুটোর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। বহ্নিমান মানে জ্বলন্ত, প্রজ্বলিত। বহ্বাড়ম্বর মানে অত্যধিক ঘটা।
বাঙালিয়ানা মানে কী, এটা নিয়ে আজও চর্চা চলে। এর তো কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হতে পারে না। অভিধান দিয়ে এ শব্দকে বেঁধে রাখার কোনও মানে হয় না। বরং বিশদে বলার বদলে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গল্প ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ পড়ে নেওয়া যায়। সেখানে বাসের ভিতর বাঙালি ভদ্রলোকের পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিচ্ছিল পকেটমার। তিনি সেটা বুঝতে পারছিলেন। তবু কিছু বলেননি। শুধু বাড়ি এসে বলেছিলেন, ‘পাবলিক বাসে এক গাড়ি লোকের ভিতর একটা সিন হবে, আর তার মধ্যে একটা প্রমিনেন্ট পার্ট নেব আমি–এ হতে দেওয়া যায় না।’ এখনকার বাঙালিকে ওই রকম চুপচাপ পকেটমারি দেখে চলে আসতে বলা হচ্ছে না। কিন্তু বাঙালিয়ানার বদল ঘটে গিয়েছে অন্য জায়গায়।
অন্তঃকরণ বিশাল। হৃদয়ও তাই। কুৎসিত ভাষা দেখলে সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে। মলিনতাহীন মন সবাইকে বিশ্বাস করতে শেখাত। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আলাদা টান, যা ভিনরাজ্যের রেল কলোনিতেও বিস্তারিত হয়ে যেত সহজে। একদা এই ছিল বাঙালিয়ানার অঙ্গ। এখন যাঁর ভাষা যত কুৎসিত, তিনি যত উদ্ধত, তিনি ততই বড় নায়ক। ভুল বললাম, নায়ক নন। নায়ক আর কোথায়? ওটা হবে নেতা।
এ বছরটা আরও বিপদ। নির্বাচনের বছর। মুখের লাগাম না থাকাটা বাঙালি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নেবে স্বচ্ছন্দে। সবাই ছাড় দিয়ে দেবে। এই তো ক’দিন আগে বিজেপির এক বড় নেতা রাহুল গান্ধিকে যা বললেন, তা একেবারে রাস্তার ভাষা। নেতার বাড়ি মেদিনীপুর। একদা যেখানে জন্ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। দুর, তাতে কী এসে গেল? এখন বিদ্যাসাগরকে বাঙালি চেনে না, কাগজে অত নাম বেরোয় না, টিভিতে দেখা যায় না। ওই নেতাকে বেশি দেখা যায়।
এখন কচি নেতা-নেত্রী পাওয়াই বেশি সহজ। অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকার তুলনায়। এঁদের এত আকাল, একটা সিনেমা বা সিরিয়াল করলেই প্রচুর প্রচার। লেখার জায়গা, দেখানোর জায়গা তো ভরাট করতে হবে। গায়করা নির্মলেন্দু চৌধুরী-স্বপ্না চক্রবর্তী-মৌসুমী ভৌমিক-রুনা লায়লার গানের কোলাজ এমনভাবে তৈরি করে ফাংশনে গেয়ে চলে যাবেন, মনে হবে এসব তাঁর নিজের গান। আপনি একটা সিনেমা করবেন, নায়ক-নায়িকা খুঁজতে মাথার চুল উঠে যাবে। দেব বাদে এখন কেউ নেই, যাঁর নামে হল ভরবে। দেবের সঙ্গে পাল্লা দিতে এখনও ভরসা সেই জিৎ। চোখ বন্ধ করে নেওয়ার মতো জনপ্রিয় নায়িকা তো নেই-ই।
যে জিনিসটা সত্তর দশকের টালমাটাল সমাজ ব্যবস্থায় বাঙালিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই ফুটবলও আর বাঙালির নেই। ক’দিন আগে ওডিশায় সুপার কাপ ফুটবলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলল। এটা কলকাতা ডার্বি না স্প্যানিশ কোনও ডার্বি বোঝা গেল না। খেলা যখন শুরু হল, তখন দুটো দল মিলিয়ে দুজন বাঙালি ফুটবলার ছিলেন মাঠে– শৌভিক চক্রবর্তী এবং রাজ বাসফোর। খেলা যখন শেষ হল, তখন মাত্র একজন- শৌভিক। সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এক প্রেস মিটে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অভিযোগ করেছিলেন, বাংলার ফুটবলারদের জাতীয় দল থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এশিয়াডে জাতীয় দলে বাঙালি ছিলেন শুধু রহিম আলি। অরূপের প্রশ্ন ছিল, বাঙালি ফুটবলার বলেই কি জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না? ওডিশা সুপার কাপের পর মোহন-ইস্টের কর্তাদের কাছেও এই জাতীয় প্রশ্ন করা উচিত ছিল ক্রীড়ামন্ত্রীর। কেন বাঙালি পরিত্যক্ত? দুটো ক্লাবের কর্তাদেরই তিনি ঘনিষ্ঠ। প্রশ্নটা কিন্তু তোলেননি। ফেডারেশন চালাচ্ছে বিজেপি, বড় ক্লাব চালাচ্ছে তৃণমূল। তাই জন্যই সোনালি নীরবতা?
বাঙালির অন্য নয়া ট্রেন্ড, ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান জিতলে এখন বাঙালি সাংবাদিকদেরও অনেকে ফেসবুক পোস্টে উল্লাস প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন হল, তৃণমূল-বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম জিতলেও কি সাংবাদিকরা এমন পোস্ট করতে পারেন? করা উচিত? কোনও পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ্যে দেখানো যেমন অন্যায়, ক্লাবের ক্ষেত্রেও তো একই কথা খাটে। নিরপেক্ষতা তাহলে থাকল কোথায়? এখন অবশ্য বাঙালির কোনও পেশায় নিরপেক্ষতার দায় নেই। হয় তুমি এদিকে থাকো, না হয় ওদিকে। সরাসরি থাকো। নিরপেক্ষ থাকলেই নাকি তুমি সুবিধাবাদী!
বাংলা ফুটবলের এত দুর্দশা, যে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে সাড়া ফেলা বাঙালি দল ইউনাইটেড স্পোর্টসকে ক্রাউড ফান্ডিং করে আই লিগ খেলতে হচ্ছে। তাতে ফুটবলপ্রেমী বা কর্তাদের মাথাব্যথা নেই কোনও। ইউনাইটেডের ছ’টি বয়সভিত্তিক টিম। মোহন-ইস্ট-মহামেডান কর্তাদের যা কল্পনাতেও আসবে না।
ছ’টা জুনিয়ার টিমের সঙ্গে ইউনাইটেডের তিনটি টিম খেলে কলকাতা লিগে। মোট বাজেট ১ কোটি। ১০ লক্ষ ক্রাউড ফান্ডিং টার্গেট করে উঠেছে ৩ লক্ষ। অথচ ইস্ট-মোহনের এক কোচ বা প্লেয়ারের বাজেটই কোটির বেশি। নেতা-মন্ত্রীর কিছু ক্লাব নেমে পড়েছে ময়দানে প্রচুর বাজেট নিয়ে। তাঁদের অনেকের দুর্গাপুজোর যা বাজেট, তাতে গোটা কুড়ি ইউনাইটেড ক্লাব চলে যাবে। ইউনাইটেড টিমটা শ্যামনগরের। ব্যারাকপুর থেকে কল্যাণীজুড়ে উৎসব হয় প্রায় ১৭টি জায়গায়। এই উৎসব বাজেটও ভাবুন। মাস কয়েক আগে নেতারা বিবেকানন্দের গীতা পাঠ এবং ফুটবল খেলার মন্তব্য নিয়ে মিছিলে নামলেন। কেউ বললেন না, উৎসব বন্ধ করে সেই বাজেটে বাঙালিকে ফুটবল ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হোক।
বাঙালির পোশাকের বাঙালিয়ানা, বাঙালি সংস্কৃতিও এখন আটকে রয়েছে এই ধরনের উৎসবের মঞ্চের অনুষ্ঠানে। আর শুধুই দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত। বাংলা বই যেমন বাঙালির চর্চা-ভাবনার বিষয় স্রেফ বইমেলার কয়েকটা দিনের জন্য।