- শাঁওলি দে
মে মাসটা শুধু শ্রমিক দিবসের জন্যই বিখ্যাত নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে এইসময় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়৷ তাই মে মাস ফল প্রকাশেরও মাস।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পর টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ সব জায়গায় কিছু মুখ জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়৷ প্রথম দশে, প্রথম কুড়িতে স্থান পায় ওরা। মিষ্টিমুখের ছবিতে ভরে ওঠে চারিদিক, বারো-ষোলো ঘণ্টা পড়ার গল্প৷
সাংবাদিকদের সামনে সাবলীল বাচনভঙ্গি, উন্নত শির, নিজের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত ফোকাস এইসব ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে চরম আত্মবিশ্বাসের ছাপ। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা বিজ্ঞানী, কেউ আরও কত কী হতে চায়, চোখে তাদের সেসব হওয়ারই দৃঢ়প্রত্যয়।
এত এত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এসবের মাঝে একটা দুটো গলার স্বর ভিড় ঠেলে যেন বেরিয়ে আসে, কিংবা কোনও কোনও বছর তাও আসে না। তীব্র আওয়াজে এদের কথা হয়তো সাংবাদিকদের কানে পৌঁছায়ই না, এরা কেউ কেউ খুব ক্ষীণভাবে বলে ওঠে, আমি শিক্ষক হতে চাই৷ হতে চাই মানুষ গড়ার কারিগর।
না, কেউ আর মানুষ গড়তে চায় না এখন, সে যারা গড়ার তারা গড়ুক। আমরা ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এরকম করে যে হারে শিক্ষকতা পেশার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কমছে, তাতে ভবিষ্যতে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ হয়!
শুধু ছাত্রছাত্রীই নয়, ছেলে কিংবা মেয়েকে সমাজের সবচাইতে উচ্চস্থানে দেখার নেশায় বেশিরভাগ বাবা-মা কেউই আর শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখেন না৷
চিন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে শিক্ষকতাকে সমাজের সবচেয়ে উচ্চশ্রেণিতে রাখা হয়। কোনও পাবলিক প্লেসে শিক্ষককে দেখা গেলে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় জনগণ। দোকানে, শপিং মলে, সিনেমা হল বা ব্যাংকে কিংবা থিয়েটারে তাঁদের সবচেয়ে আগে সুযোগ দেওয়া হয়৷ কারণ একমাত্র একজন শিক্ষকই পারে সমাজের শিরদাঁড়াকে সোজা করে রাখতে৷
অন্যদিকে তুরস্ক, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারতবর্ষের মতো দেশে এই চেহারাটা একেবারে উলটো। এখানে শিক্ষকতাকে ততটা মর্যাদা দেওয়া হয় না। চেহারাটা ইদানীং আরও নগ্ন হয়ে গিয়েছে।
কিছু বছর আগেও বিষয়টা অন্যরকম ছিল। এখনও মনে পড়ে, আশি-নব্বইয়ের দশকে আমরা দূর থেকে মাস্টারমশাইদের দেখতে পেলে রাস্তা পালটে নিতাম। সাইকেল থেকে নেমে পড়তাম। এসব এখন ব্যতিক্রমী ঘটনা, স্বাভাবিক ঘটনা হল সাইকেলের ঘণ্টা শুনে আপনি পেছনে তাকিয়ে সরে দাঁড়াবেন। একঝাঁক ছাত্র আপনাকে উপেক্ষা করে অথবা ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে যাবে অনেকটা দূর।
কতটা দূর আদৌ তারা যাবে জানি না। তবে যেখানে পৌঁছাবে দেখতে পাব সেখানে কেউ সোজা, উন্নত শির দাঁড়িয়ে নেই, কারণ মেরুদণ্ড সোজা করার কারিগরেরই যে বড্ড অভাব আজ।
(লেখক শিক্ষক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)