উত্তর সম্পাদকীয়

কর্মক্ষেত্রে ঋতুকালীন ছুটি নারীর ক্ষমতায়নেরই বাধা

  • তপতী গায়েন

প্রথম ঋতুবতী হওয়ার দিন থেকে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই আমার বালিকা বেলাও আবদ্ধ থেকেছে চরম বিধিনিষেধের বেড়াজালে। প্রতি মাসের চারটে-পাঁচটা দিন কার্যত, কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠত।

পুজোপাঠ, আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান থেকে যত সম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করা হত আমাকে৷ শেখানো হত, কাউকে বলবে না, ঠাকুর ঘরে ঢুকবে না, পবিত্র কিছু ছোঁবে না৷ আর আমার বিদ্রোহী মনে হাজার কেন-র নাছোড় প্রশ্নের বাণ আছড়ে পড়ত মায়ের কাছে। যদিও এইসব প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর ছিল না তাঁরও৷ প্রচলিত রীতি, কুসংস্কারকে হাতিয়ার করেই তিনি যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করতেন৷ প্রতি সমাজ নিজেদের মতো করে তার উত্তর যেমন সাজিয়ে নেয়, অনেকটা তেমনই৷

ঠিক যেভাবে আজ উত্তর সাজিয়ে নিচ্ছে ‘পিরিয়ড লিভস’ বা ঋতুকালীন ছুটির বিষয়টি৷ সম্প্রতি ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রক পিরিয়ডসের দিনগুলিতে বিশেষ ছুটির দাবিতে সংসদে রিপোর্ট জমা করেছিল৷ যদিও তা পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তাঁর মতে, এতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতি বৈষম্য বাড়বে। সমান সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবেন।

স্মৃতির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলতে পারি পিরিয়ডসের জন্য ছুটি না রাখাই শ্রেয়৷ কারণ, প্রতিটি ধাপে যেখানে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ও ‘লিঙ্গসাম্য’ নিয়ে প্রতিনিয়ত আন্দোলন হচ্ছে, সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে জোরকদমে, সেখানে এই ছুটি মহিলাদের বহু যোজন পিছিয়ে দেবে। সমান অধিকারের লড়াইকে দুর্বল করে দেবে। বিশেষ সুবিধা ভোগের অভিযোগে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে কম সংখ্যায় নিয়োগের অজুহাতও হয়ে উঠবে এটি। আঙুল তুলতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না যে, ‘আরে, ওদের তো আবার মাসে বাড়তি ছুটি বাঁধা৷ ভালোই আছে৷ মেয়ে হয়ে যে আর কত সুবিধা পাবে!’

ঠিক যে কারণে মা হওয়ার পরে বহু মহিলাকে কর্মক্ষেত্রে নানা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়! শিশু প্রতিপালনের ছুটি নিয়ে হাজার প্রশ্ন ওঠে! সেই একই কারণে ‘ঋতুকালীন ছুটি’-ও হয়ে উঠবে একটা বৈষম্যের মাপকাঠি। এনিয়ে শুরু হবে নানা নোংরা টিপ্পনীও৷ তাই বলে, একজন মহিলা হয়ে আমি মোটেই অস্বীকার করছি না যে, এ সময়ে মেয়েদের কোনও শারীরিক সমস্যাই হয় না। বরং অসম্ভব পা ব্যথা, কোমর ব্যথা সহ একাধিক জটিলতা এতটাই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় যে মাঝে মাঝে মনে হয় ছুট্টে বাড়ি চলে যাই৷ একটু শুয়ে থাকলে, বিশ্রাম করলে বোধহয় ভালো লাগবে৷ এসব দিক থেকে দেখতে গেলে এই ছুটির বিষয়টা তো আমাদের লুফে নেওয়া উচিত। তবু তারপরও বলব, ‘ঋতুকালীন ছুটি’ মেনে নিতে না পারার প্রথম কারণটাই হল, এটা লিঙ্গসাম্যের পথে বিশাল অন্তরায়৷

এ ছুটি দিলে সমাজ থেকে ঋতুকালীন ছুঁতমার্গ কাটবে না৷ যাবে না কুসংস্কারও৷ প্রতি মাসে মহিলাদের চার-পাঁচটা দিন ‘অপবিত্র’ সে ধারণাও থেকে যাবে বহালতবিয়তে। তার থেকে এটা নিয়ে আলোচনা হোক, সচেতনতা বাড়ুক৷ এটা যেমন ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার বিষয় নয়, তেমনই এটা লুকিয়ে রাখার বিষয়ও নয়৷ স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হিসেবে তা সমাজের সামনে তুলে ধরলেই অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে৷ তাই ছুটির পরিবর্তে আমাদের সেই বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

(লেখক শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের শিক্ষক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Siliguri | শিলিগুড়িতে নর্দমা থেকে উদ্ধার হোটেলকর্মীর মৃতদেহ

শিলিগুড়ি: সেবক রোড সংলগ্ন এলাকার একটি নর্দমা থেকে উদ্ধার হল এক ব্যাক্তির মৃতদেহ। শনিবার সকালে…

1 min ago

Alipurduar | জেলা হাসপাতালে আবর্জনার পাহাড়, দুর্গন্ধে দমবন্ধ

মণীন্দ্রনারায়ণ সিংহ, আলিপুরদুয়ার: আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) জেলা হাসপাতালের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাবের বারান্দায় নাকে রুমাল চাপা…

1 min ago

চা বাগানে নানান সমস্যা ঘিরে উদ্বেগ শ্রমিক ইউনিয়নে পদক্ষেপের আর্জি জানিয়ে শ্রমমন্ত্রীকে চিঠি নাগরাকাটা, ১৭…

4 mins ago

Alipurduar | খুলে গিয়েছে জেলার অধিকাংশ হিমঘর, আরও লাভের আশায় আলুচাষিরা

শামুকতলা: আলিপুরদুয়ার জেলায় আলুচাষিদের মধ্যে এখন খুশির আমেজ। খুলে দেওয়া হয়েছে জেলার অধিকাংশ হিমঘর। জানা…

7 mins ago

Teachers | আপনি যোগ্য তো? বাংলার সব শিক্ষকের কাছে নথি চাইল শিক্ষা দপ্তর

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এবার বাংলার সব শিক্ষককে জমা দিতে হবে নথি। সেই নথির ওপর…

11 mins ago

Bengal Schools | কাউন্সিলের নির্দেশে বিপাকে রাজ্যের ১২০০ স্কুল

সপ্তর্ষি সরকার, ধূপগুড়ি: শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন রাজ্য তোলপাড় তখন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের (WBCHSE)…

17 mins ago

This website uses cookies.