দেওয়ানহাট: তার বয়স তখন সবে পাঁচ। বাবা-মায়ের হাত ধরে সে পৌঁছে গিয়েছিল গোলাপি শহর জয়পুরে। কোচবিহার-১ ব্লকের গৌরাঙ্গবাজার এলাকার ছোট্ট একটা বাড়ি থেকে সুদূর রাজস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বাবা-মা। বছর চারেক সেখানে থেকে পড়াশোনার পর ফের কোচবিহারের বাড়িতে ফিরে আসে দীপশিখা বর্মন। কিন্তু বাবা-মা ফেরেননি। তারপর থেকে ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছে থেকেই দীপশিখার পড়াশোনা শুরু। সেই ছোট দীপশিখার বয়স এখন ষোলো। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে ৬১০ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকের মেয়ের এহেন ফলাফলে খুশির হাওয়া এলাকায়।
গৌরাঙ্গবাজার হাইস্কুলের ছাত্রী দীপশিখা বাংলায় ৮০, ইংরেজিতে ৮০, অঙ্কে ৯০, ভৌতবিজ্ঞানে ৮৩, জীবনবিজ্ঞানে ৯৫, ইতিহাসে ৮৬ ও ভূগোলে ৯৬ নম্বর পেয়েছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে বাবা-মায়ের দুঃখকষ্ট দূর করতে চায় সে। পাশাপাশি সমাজের কল্যাণে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে তার। ইতিমধ্যেই সে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
দীপশিখাদের বসতভিটে বাদে সামান্য চাষের জমি। বাবা দুলাল বর্মন সাইকেল মেকানিক। কিন্তু এখানে কাজ করে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই বছর দশেক আগে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেন। সেখানে গিয়ে তিনি সাইকেল সারানোর কাজ শুরু করেন। পরে মেয়েকে বাড়িতে এনে গৌরাঙ্গবাজার হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই থেকে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ছাড়াই দীপশিখার লড়াই শুরু।
দীপশিখা বলছে, ‘স্কুলের বন্ধুরা সবাই নিজের বাবা-মাকে কাছে পেত। অথচ আমার সেই সুযোগ ছিল না। প্রচণ্ড কষ্ট হত।’ তবুও নিজের লক্ষ্যের কথা ভুলে যায়নি সে। মাধ্যমিকের এই ফলাফল তার সেই লক্ষ্য পূরণের প্রাথমিক ধাপ। এরপর আরও ‘অনেক লড়াই বাকি’, বলছে দীপশিখা। যদিও বাংলা ও ইংরেজির নম্বরে সে সন্তুষ্ট নয়।
দীপশিখার এই ফলাফলে তার বাবা-মা সহ পরিবারের সকলেই দারুণ খুশি। জয়পুরে তার বাবার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলছেন, ‘মেয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই চাই।’ মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ‘যতদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হয় থাকব’, বলছেন দুলাল। মা চন্দনা বর্মন স্বামীর কথায় সায় দেন। তিনি নিজেও সেখানে গৃহশ্রমিকের কাজ করেন।
অন্যদিকে কৃতী দীপশিখাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্কুলের প্রধান শিক্ষক কান্তেশ্বর বর্মন। বলছেন, ‘প্রতিকূলতার মধ্যেও দীপশিখা দমে যায়নি। ও আমাদের স্কুলের গর্ব।’ পড়াশোনায় যে কোনও প্রয়োজনে ‘আমরা পাশে থাকব’ বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
