শমীদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: কোচবিহারের সিতাই থেকে কাজের সূত্রে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। কথাবার্তা, আচার-আচরণ ভালো থাকায় খুব সহজেই মন জয় করে নিয়েছিলেন শহরের এক তরুণীর। একসঙ্গে থাকতেও শুরু করেছিলেন দুজনে। তরুণীও বিয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। ঠিক যেন সিনেমার মতো এগোচ্ছিল গল্পের প্লট। কিছুদিন বাদে হঠাৎ একটা সন্দেহে বদলে যায় তরুণীর চিন্তাভাবনা। খোঁজ করতে করতে তরুণী চলে যান সিতাইয়ে নজরুলের বাড়িতে। সেখানে গিয়েই চক্ষু ছানাবড়া তাঁর। যার সঙ্গে এতদিন ঘরসংসার করবেন বলে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলেন সে নাকি বিবাহিত! শুধু তাই নয়, রয়েছে সন্তানও।
অগত্যা থানার দরজায় গিয়ে ‘প্রতারিত’ হওয়ার কাহিনী শোনান পুলিশকর্মীদের। শিলিগুড়ি মহিলা থানায় করা অভিযোগের ভিত্তিতে নজরুল এখন জেল হেপাজতে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস, প্রতারণা আরও কত অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তবে, এটা যে বিক্ষিপ্ত ঘটনা, তা কিন্তু নয়। কারণ প্রতিমাসে প্রেমের আড়ালে প্রতারণা ও সহবাস সংক্রান্ত গড়ে বারোটি অভিযোগ জমা পড়ছে শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনারেট এলাকার বিভিন্ন থানায়। শিলিগুড়ি মহিলা থানায় গত তিন মাসে এমন ১১টি অভিযোগ এসেছে। চলতি মাসে এখনও পর্যন্ত সংখ্যাটি ৭। ফলে দিন-দিন যে এই ধরনের ঘটনা বাড়ছে তা প্রমাণিত।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্ত করে পুলিশ দেখেছে, অভিযুক্তরা মূলত ভিনজেলা বা ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। সকলেই প্রায় কাজের সূত্রে এখানে ঘাঁটি গাড়ছে। বাইরের হওয়ায় পরিচিতি নিয়ে বিশেষ কিছু জানার সুযোগ থাকছে না কারও। আর সেই সুযোগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেমের ফাঁদ পাতছে তারা। টার্গেট মূলত বাইরে থেকে এখানে পড়তে আসা তরুণীরা। কিছু ক্ষেত্রে শহরের তরুণীরাও তাদের শিকার হচ্ছেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার নাবালিকাদের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে।
শিলিগুড়ি কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অমল রায়ের মতে, ‘আসলে ভার্চুয়াল যুগে প্রেমটা এখন তাৎক্ষণিক ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অপশন থাকছে। এই অবস্থায় মোবাইলের মাধ্যমে আধুনিক সমাজের মনে সূক্ষ্মভাবে ভোগবাদ-টাও ঢুকে গিয়েছে। যা থেকেই এই যাবতীয় সমস্যার সূত্রপাত।’
কখনও বড়লোক ‘প্রেমিকা’র টাকার প্রতি লোভ, কখনও আবার শারীরিক চাহিদা। মূলত এই দুই কারণেই এমন ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা। অভিযুক্তরা যেহেতু বাইরের বাসিন্দা, সেহেতু ‘প্রতারিত’ হলেও অনেকসময় মেয়েদের কিছু করার থাকছে না। কেউ কেউ পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন বটে, কিন্তু আখেরে কোনও লাভ হয় না।
আবার পুলিশের একাংশ এও মনে করছে, সম্পর্কে থাকাকালীন দুজনের সম্মতিতেই শারীরিক সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। কিন্তু প্রতারিত হওয়ার পর কেউ কেউ ধর্ষণের মামলাও জুড়ে দিচ্ছেন, যা ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে সমাজে।
আইনজীবী অত্রি শর্মা বলছেন, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কটা দু’পক্ষের মতেই হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রেমের পেছনে থাকা স্বার্থটায় যখন ব্যাঘাত হচ্ছে, তখনই যাবতীয় অভিযোগ উঠছে। তবে এধরনের ঘটনায় অনেকক্ষেত্রে গতানুগতিক ধর্ষণের ধারা দেওয়া হচ্ছে, যা উচ্চ আদালতে সাধারণত মানা হয় না।’
মাসখানেক আগে স্কুল শিক্ষিকার একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে প্রেমের জালে জড়িয়েছিল এক তরুণ। এক্ষেত্রে অবশ্য ওই তরুণ শহরেরই বাসিন্দা ছিল। তথাকথিত প্রেমিকার থেকে টাকা না পেতেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে তার। আসলে প্রেম নয়, শিক্ষিকার টাকা হাতানোই ছিল প্রেমের মূল উদ্দেশ্য।
আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে না জেনে না চিনে প্রেমে জড়িয়ে পড়াটা ভয়ংকর ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই মনে করছেন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলাররা। মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী মৌকণা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার সময় দৈহিক চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। আর এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অন্য সংস্কৃতিকে অনুকরণ করতে গিয়ে অনেকেই বিপথে পা বাড়াচ্ছে। সেটা হওয়া কাম্য নয়।’