সৌভিক সেন ও অনিমেষ দত্ত
শিলিগুড়ির সেবক রোডে একটি কোচিং ইনস্টিটিউটের বাইরে পড়ুয়াদের জটলা। কাছে যেতেই তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট হল, সকলে নিটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পড়ুয়াদের মধ্যে একজন অলখ স্যরের ভিডিও দেখিয়ে বাকিদের থার্মোডায়নামিক্সের কিছু ইকুয়েশন বুঝিয়ে দিচ্ছে। খানিকটা একইরকম ছবি দেখা যায় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে। গৌড়বঙ্গের তিন বড় শহরেও সেরকম দৃশ্য চোখে পড়ে আজকাল।
প্রশ্ন হল, কে এই অলখ স্যর? এতদিন শুধুমাত্র নিট, জেইই-মেইনস কিংবা অ্যাডভান্সের প্রস্তুতি নেওয়া পড়ুয়াদের মধ্যে এই নাম জনপ্রিয় ছিল। নিট বিতর্কের আবহে এখন গোটা দেশ তাঁকে চিনে ফেলেছে। এই অলখ পান্ডেই ডিজিটাল কোচিংয়ের প্ল্যাটফর্ম ‘ফিজিক্সওয়ালা’র(Physics Wallah) প্রতিষ্ঠাতা। যাঁর দৌলতে নিট কেলেঙ্কারির একটা দিক প্রকাশ্যে এসেছে।
সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) অলখ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এনটিএ গ্রেস নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে নিজেদের ভুল স্বীকার করেছে বটে, কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে নির্বিকার কেন? এমনকি হাই কাটঅফ নিয়েও চুপ কেন? আমাদের লড়াই শেষ হয়নি, এটা চলবে।’
তাঁকে ঘিরে সুবিচার পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকরা। সম্প্রতি ‘ফিজিক্সওয়ালা’ ইউটিউব চ্যানেলে অলখের একটি সাক্ষাৎকার আপলোড করা হয়েছে। তার কমেন্টবক্সে সাক্ষী মোর নামে এক পড়ুয়া লিখেছেন, ‘আমরা এতদিন শুধুমাত্র ওয়েব সিরিজ কোটা ফ্যাক্টরির জিতু ভাইয়া চরিত্রটি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। বাস্তব জীবনেও এবার তেমন একজনকে পাশে পেয়েছি। অলখ স্যর সত্যিকারের ইনস্পিরেশন।’
প্রয়াগরাজের অলখ পান্ডে ভারতে আলোচনার মধ্যমণি হলেও বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল কোচিংয়ে প্রথম যাঁরা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম সলমন খান। আমেরিকায় জন্ম হলেও তাঁদের পৈতৃক ভিটে বাংলাদেশের রহমতপুরে। সলের মা মাসুদা খানের বাড়ি আবার মুর্শিদাবাদ। আমেরিকা তাঁকে চেনে সল খান বলে।
কে এই সল? ফিরে যেতে হয় ২০০৪ সালে। ইয়াহুর ডুডল নোটপ্যাডে সল প্রথম পড়ানো শুরু করেন। খুড়তুতো বোনকে অঙ্ক শেখাতেন। তাঁর পড়ানো ভালো লেগে যায় বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের। চাহিদা বাড়ে। অবশেষে ২০০৬ সালে ইউটিউবে একটি চ্যানেল খুলে ফেলেন। সেখানে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করা শুরু। এরপর হুহু করে বেড়েছে তাঁর জনপ্রিয়তা। তৈরি হয়েছে ডিজিটাল লার্নিংয়ের প্ল্যাটফর্ম ‘খান অ্যাকাডেমি।’ সেখানে পড়ুয়াদের বিনামূল্যে টিউশন দিয়ে গিয়েছেন বছরের পর বছর। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি ভিডিও আপলোড করেছে খান অ্যাকাডেমি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত খান অ্যাকাডেমি ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৮১ লক্ষের বেশি। আরও শুনুন, ২০১২ সালে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশেষ স্বীকৃতি দেয়। সেই বছরই ফোর্বসের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন বছর ৪৮-এর সল। এমনকি ২০১৬ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী দেয় ভারত সরকার।
ফিজিক্সওয়ালা অলখও শূন্য থেকে সবটা শুরু করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু জীবনের মোড় কখন শিক্ষকতার দিকে বাঁক নিয়ে নেবে, তা হয়তো কল্পনাতেও ভাবেননি অলখ। একসময় তাঁর আর্থিক পরিস্থিতি বেশ টালমাটাল হয়ে পড়ে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে টিউশনিতে হাতেখড়ি। কানপুরের সারকোর্ট বাটলার কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেও শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্যে কলেজ ছেড়ে দেন।
২০১৬ সাল। অলখের ‘স্যর’ হওয়ার অধ্যায় শুরু। ইউটিউবে একটি চ্যানেল খুললেন, ফিজিক্সওয়ালা। তবে শুরুতেই সাফল্য আসেনি। নিয়মিত ভিডিও আপলোড, লাইভ সেশন, মক টেস্টের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাবস্ক্রাইবার বাড়তে থাকে। কোভিডের সময় থেকে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। বাকিটা ইতিহাস। বর্তমানে নয়ডায় ফিজিক্সওয়ালার সদর দপ্তর। কুড়িটি অফলাইন সেন্টার, অ্যাপ আরও কত কী। বর্তমানে ফিজিক্সওয়ালার আওতায় ইউটিউব চ্যানেলের সংখ্যা হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়েছে। একটি চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যাই ১ কোটি ২৪ লক্ষ! ২০২২ সালে তাঁর কোম্পানির ভ্যালুয়েশন গিয়ে দাঁড়ায় ১.১ বিলিয়ন ডলার।
১৮ বছরের আশিস যাদব অলখের ক্লাস কখনও মিস করে না। সে লিখেছে, ‘অলখ স্যর একমাত্র যিনি নিট পরীক্ষার্থীদের হয়ে আওয়াজ তুলেছেন।’ শুধু ফিজিক্স পড়ানোই নয়, ক্লাসে জীবন এবং বন্ধুত্ব নিয়ে অলখ মাঝেমধ্যেই পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনা করেন; তাঁদের পথ দেখানোর চেষ্টা করেন। তাই হয়তো অনেকের কাছে আজ তিনি ‘হিরো’।
শুধু কি পড়ুয়া? ৬৭৫ নম্বর পেয়েও ১৩০০০ র্যাংক করা এক পড়ুয়ার মা অলখের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘সমস্ত শিক্ষার্থী আপনার কাছে ফিজিক্স পড়েছে। তারা এখন সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে। আমরা সুবিচার চাই।’
এই ফিজিক্সওয়ালাদের মতো প্ল্যাটফর্ম বর্তমানে সারা ভারতের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের পড়ুয়াদের প্রস্তুতির জন্য বড় ভরসা। অভিভাবকরাও সমানভাবে আগ্রহী ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে ডিজিটাল লার্নিংয়ে।
কথা হচ্ছিল আলিপুরদুয়ারের ছাত্র অভীক দাসের বাবা প্রদীপকুমার দাসের সঙ্গে। পেশায় শিক্ষক তিনি। বলছেন, ‘সেরা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেতে গেলে ভালো র্যাংক করতে হবে। শুধুমাত্র স্কুল এবং প্রাইভেট টিউশন পড়ে কোটা বা হায়দরাবাদের ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা সহজ নয়। আলিপুরদুয়ার শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের কোচিং ইনস্টিটিউট নেই। রয়েছে শিলিগুড়িতে। কিন্তু অভীক বাড়িতে থেকে প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিল। মুশকিল আসান করে দেয় ডিজিটাল ক্লাস।’
এই অভিজ্ঞতা শুধু প্রদীপবাবুর নয়। কোচবিহারের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী এক বছর ধরে বাড়ি থেকে নিটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার বাবা প্রথমে কোচবিহার শহরে খোঁজখবর করেন। কিন্তু সব ধরনের সুবিধা এক জায়গায় রয়েছে, তেমন ইনস্টিটিউট খুঁজে পাননি। তারপর স্কুলের এক দিদির থেকে জানতে পেরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন নেন। এখন প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।
এই ঘরে বসে প্রস্তুতির সুযোগটাই ডিজিটাল কোচিংয়ের অন্যতম সাফল্যের দিক। এখানে ক্লাস ‘মিস’ যাওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। প্রতিটা ভিডিও রেকর্ডিং অ্যাপেই মেলে। সময় সুযোগমতো দ্যাখো, আর পড়ো।
ফিজিক্সওয়ালায় প্রস্তুতি নিচ্ছে কোচবিহারের আরমিন হাসান, সায়ন্তিকা রায়। প্রস্তুতি নিয়ে সফল হয়েছেন মালদার শরিফা খাতুন। তালিকাটা লম্বা। এরা সকলেই এই ব্যাপারে সহমত যে, এই প্ল্যাটফর্মগুলি আসার ফলে অনেক পড়ুয়া সাধ্যের মধ্যে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে। ফিজিক্সওয়ালা ছাড়াও আনঅ্যাকাডেমি, বাইজ্যুস, আড্ডা-২৪X৭, অলিভ বোর্ডের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি এখন সবার মুঠোফোনে। তবে খুঁজতে গিয়ে অবাক হতে হল, বাংলা থেকে এই ধরনের উদ্যোগ হাতেগোনা।