গাজোল: তিন পুরুষ ধরে গাজোলের ভিতর বাজারে শ্যামামায়ের শোলার অলংকার তৈরি করে আসছেন নরেন্দ্রনাথ দাস। ৬২ বছর বয়সী নরেন্দ্রনাথ দাস চোখে ঠিকমত দেখতে না পেলেও চশমার মধ্যে দিয়ে তার হাতের কারুকার্য ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তাঁর বাড়ি গাজোল ব্লকের মোল্লাদিঘি গ্রামে। বর্ধমানের জমিদার বাড়ির শ্যামামায়ের পুজো হয় গাজোলের ভিতর বাজারে। শ্যামামায়ের মন্দিরে প্রচুর ভক্তদের সমাগম হয়। শ্যামামায়ের শোলার সাজ ও অলংকার তৈরি করে তেমন পারিশ্রমিক না পেলেও মনে ভক্তি নিয়ে কাজ করে চলেছেন ওই দাস পরিবার। দিন দিন এলাকা থেকে শোলা হারিয়ে যাচ্ছে এলাকার স্থানীয় পুকুর থেকে। মাছ চাষিরা মাছ চাষ করবেন বলে পুকুর পরিষ্কার করে দেন তাই স্থানীয় পুকুর গুলিতে আর শোলা পাওয়া যায় না। শোলাগুলি কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে বাইরে থেকে। দিনদিন মূল্য বাড়ছে সরঞ্জামের। কিন্তু তেমনভাবে মিলছে না পারিশ্রমিক একথা জানালেন ওই শিল্পী নরেন্দ্রনাথ দাস।
শিল্পী নরেন্দ্রনাথ দাস জানান, তিনি তার বাবাকে দেখতেন এই শ্যামামায়ের অলংকার তৈরি করতে। তখন ১৯৭৫-৭৬ সাল হবে তখনই জানা যায় যে মালদার এক কারিগর এই শ্যামামায়ের মূর্তির শোলার অলংকার ও সাজ তৈরি করতো কিন্তু ওই শিল্পী গত হওয়া হওয়ার পর থেকেই আমার বাবার উপর দায়িত্ব আসে। বাবা ও দায়িত্ব স্বরূপ এই কাজটা করে আসতেন পারিশ্রমিকের চিন্তাধারা না করে। যা দিত তখন তা হয়ে যেত ভক্তি মনে। ধীরে ধীরে বাবা আমাকে ওই অলংকার তৈরির সময় খেলা থেকে ডেকে নিয়ে এসে বসাতো। পাশে বসিয়ে কাজ শেখাতো। এবং সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে বাবার হাত ধরে এই কাজ শেখা। বর্তমানেও আমি আমার ছেলে কেউ এই কাজ শিখিয়ে চলেছি। আমার বাবার নাম গিরিশ দাস। বহুদিন তিনি এই জমিদার বাড়ির শ্যামামায়ের পুজোর সময় মায়ের অলংকার ও সাজ তৈরি করে ছিলেন। বর্তমানে শ্যামামায়ের অলংকার ও সাজ ছাড়াও গম্ভীরা, বুড়ি মায়ের পুজোর মুখোশ এবং পাশাপাশি মাটির মূর্তিও করে তৈরি করে থাকি। শ্যামামায়ের অলংকার ও সাজ তৈরি করেও তেমন পারিশ্রমিক না মিললেও মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়েই কাজ করে থাকি এবং মাকে ভক্তি করে বলে এই কাজটি করে আসছি। আগামী দিনেও করে যাব। এই সাজ তৈরি করতে প্রায় হাজার দেড় এক টাকা খরচা হয়। আগে গ্রামেগঞ্জে পুকুরে এই সোলা গুলা পাওয়া যেত। এখন আর এলাকার পুকুর গুলিতে শোলা পাওয়া যায় না মাছ চাষিদের জন্য। নবাবগঞ্জের হাট থেকে কিনে নিয়ে আসতে হয়। জমিদার আমলের এই শ্যামামায়ের পুজো দেখে আসছি বহুদিন ধরে। বাবার হাত ধরে কাজ শেখা তারপরে আমি ছেলেকে শেখাই ছেলেও আর আমি দু’জন মিলেই এখন এই কাজ করে আসছি প্রায় আটদিন ধরে এই কাজ চলে।
নরেন্দ্রনাথ দাস বাবুর ছেলে উৎপল দাস জানান, তিনি গৃহ শিক্ষকতার পাশাপাশি বাবার এই কাজে সহযোগিতা করেন। বাবার মুখে তার দাদুর এই কাজের কথা শুনে আসছেন। শ্যামামায়ের মূর্তির সাজ ও অলংকার বাবাও প্রায় ১৯৮২ সাল থেকে করে আসছে। তিন পুরুষ ধরে এই শ্যামামায়ের শোলার গয়না ও অলংকার তৈরি হয়ে আসছে। পাশাপাশি বাবার সহযোগিতা করে আসতো কাকুরাও। বাবা গম্ভীরা মুখোশ বানাত ওই মডেল এই শ্যামামায়ের সাজসজ্জা অলংকার হয়ে আসছে। আমাদের এই তিন পুরুষের কাজ আগামী দিনেও পড়ে যাব। যদিও পারিশ্রমিক হিসাবে তেমন মূল্য পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা ভক্তিকে নিয়ে এই কাজ করে যাব ভবিষ্যতেও। বর্তমান ডিজিটাল যুগেও মেশিনের সাহায্যে অনেক প্রতিমার সাজসজ্জা তৈরি হয়ে আসছে। কিন্তু এখনও হাত দিয়ে তৈরি করা হয় এই সাজসজ্জা। সময়টা অনেক লাগে সুক্ষ কাজ করতে। যদিও এই শোলার কাজ আগে অনেক জনকে করতে দেখা যেত বেশ কিছু এলাকায়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এই শিল্পকে ধরে রাখার উদ্যোগ একমাত্র সরকার নিতে পারে। প্রশাসনের উদ্যোগে অনেক কিছুই প্রশিক্ষণ দিয়ে শেখানো হয় তেমনভাবেও যদি এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে শিল্পটি বেঁচে থাকবে।