- গৌতম সরকার
বৈষ্ণব-বিনয় যাকে বলে আর কী। ‘মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না…।’ সাত চড়েও যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা তৃণমূল সম্পর্কে রা কাড়বেন না। পণ করেছেন রাহুল, জয়রাম রমেশরা। বলার মতো হাজার কথা আছে এ রাজ্যে। কিন্তু ওঁরা যেন মুখে আঙুল-দাদা। রাহুল গান্ধি নাকি মানুষের কথা শুনতে বেরিয়েছেন। ধুলিয়ানে এক মহিলা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে নালিশ জানানোর চেষ্টা করলেন। সোনিয়া-পুত্রের যেন মনে হল, তোবা তোবা। এ সব শোনা পাপ।
ওই মহিলার দোষের মধ্যে দোষ, বলতে গিয়েছিলেন, বিড়িশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখেননি অভিষেক। রাহুলের মুখ সটান ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল বিপরীত দিকে। অন্য একজনের কাছে তামাকপাতার গুণমান শুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বন্দ্যোপাধ্যায়দের সম্পর্কে কোনও কথা উঠলেই যেন কানে দিয়েছি তুলো। পিঠে বেঁধেছি কুলোও হতে পারে। মালদায় কোনওভাবে রাহুলের গাড়ির কাচ ভেঙে গিয়েছিল।
এখনকার সংকীর্ণ রাজনীতির নিয়মে অভিযোগ উঠে গেল, কেউ ঢিল মেরেছে। সুযোগটা লুফে নিলেন অধীর চৌধুরী। কখনো-কখনো মনে হয়, যিনি শুভেন্দু অধিকারীর চেয়েও বেশি মমতার জাতশত্রু। তিনি বলতে শুরু করলেন, বুঝে নিন কে করতে পারে। জয়রাম-কানহাইয়া কুমাররা কিন্তু সুযোগ পেয়েও সেই অভিযোগের পথে হাঁটলেন না। বরং নিলেন উলটো পথ। মমতা ভজনার পথ। অধীরের ক্ষোভ থেকে তৃণমূলকে আগলে রাখতে যুক্তি দিলেন, বাংলার সরকারের বদনাম করতে কেউ এ কাজ করে থাকতে পারে।
আরেক কাঠি উপরে উঠে এআইসিসি’র মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতের সমাজমাধ্যমে লেখার মর্মার্থ ছিল, নিছক দুর্ঘটনা রে বাবা। হইচইয়ের কিছু নেই। সত্যটা বলা দরকার। আসলে নিরাপত্তারক্ষীদের দড়ির ঘষায় কাচটা ভেঙে গিয়েছে।
শুনে মনে হল, দড়ির শক্তি আছে বলতে হবে। ছোঁয়ায় খানখান হয়ে গেল রাহুলের মতো ভিভিআইপির গাড়ির কাচ। সেই থেকে সুকুমার রায়ের কবিতার লাইন আউরে চলেছি, ‘পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। উঠছে হাসি ভসভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে…।’
মমতা যখন একেবারে লাঠি উঁচিয়ে বসে আছেন, খবরদার, আর এগিও না। এ বঙ্গে জোট? কভি নেহি। সিপিএম তো বটেই, কংগ্রেস তুম তফাত যাও। রাহুল, জয়রামরা তত মানভঞ্জনের আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। যতভাবে হাত কচলানো যায়, কচলে চলেছেন।
এ সব দেখে হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। হাসির উপাদান ক্ষমতার কারবারের পরতে পরতে। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা মমতা ছিন্ন করতেই বঙ্গে যেন কংগ্রেসকে আগলে রাখার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বামেরা।
কোচবিহার থেকে মুর্শিদাবাদ দৌড়াদৌড়ি চলছে সিপিএম নেতাদের। ‘ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে। ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হাসি ফ্যাক করে…।’ রাহুলের সঙ্গে ছবি উঠছে ফটাফট। রাজীব-নন্দনের সঙ্গে একফ্রেমে মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীরা। যাঁরা এসএফআই, ডিওয়াইএফ করার সময়ে যৌবনে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখতেন, ‘অলি গলি মে শোর হয়, রাজীব গান্ধি চোর হ্যায়।’ বফর্স কেলেঙ্কারিতে রাহুলের পিতৃদেবকে ভিলেন বানাতে তখন উঠেপড়ে লেগেছিল বামেরা।
সেলিম, সুজনদের পূর্বসূরিরা তো রাহুলের ঠাকুমাকে ডাইনি বলতেন। গণতন্ত্র ধ্বংসের খলনায়িকা বলতেন। জ্যোতি বসু নিজস্ব স্টাইলে ইন্দিরার নাম উচ্চারণ না করে ওই মহিলা বলতেন। এখন সুজন, সেলিমের কাছে সেই গান্ধি পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম যেন সাত রাজার ধন মানিক। ক্ষমতার কারবারে কেউ পুরোনো কথা মনে রাখে? গান্ধিজিকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের ভোল বদল দেখছেন না? অমিত শা-রা আজকাল বাংলায় এসে এমনভাবে ‘সুভাষবাবু’ উচ্চারণ করেন, মনে হয় ওঁদের কত কাছের মানুষ ছিলেন নেতাজি।
হাসি পাবে না? এই সেদিন নেতাজি-কন্যা অনীতা বসু পাফ (যদিও সুভাষের হাতে প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক তাঁকে নেতাজি-কন্যা মানা দূরের কথা, সুভাষকে চিরকুমার রেখে আত্মপ্রসাদ লাভ করে) কলকাতায় বলে গেলেন, ‘কেউ কেউ বাবাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন, ভারত শুধু হিন্দুর নয়, মুসলিমের, শিখের, খ্রিস্টানের, জৈনের।’ শুধু অনীতার বলা কথা বলে নয়, আজাদ হিন্দ ফৌজে এই ভাবনার সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন সুভাষ।
ঐতিহাসিক সেই সত্যও গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অনীতা আক্ষেপ করেছেন, ‘আমি কিছুতেই মানতে পারি না, ইদানীং বাবা বা তাঁর মতো বরণীয়দের ভারতে এমন একটা ছাঁচে ফেলা হচ্ছে, যার সঙ্গে তাঁদের ছিটেফোঁটা সম্পর্ক নেই।’ ইতিহাস বিকৃতি দেখলে শুধু হাসি পায় না, রাগও হয়। পঞ্চাশের দশকে আমার জন্ম। শৈশব ইস্তক রাজনীতিতে যা দেখতাম, তার সঙ্গে মেলাতে পারি না বলে হাসি পায়, দুঃখও হয়।
১৯৬৭-র নির্বাচনে একদল এলাকায় প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা ভোট চাইতে বাড়িতে এসেছিলেন। বাবাকে তাঁদের মুখের ওপর বলতে শুনেছিলাম, ‘কুড়ি বছর ভোট দিয়েছি। কংগ্রেস কিছু করেনি। এবার আর কংগ্রেসকে ভোট দেব না।’ ওইরকম দাপুটে নেতারা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। যাওয়ার সময় শুধু মিনমিন করে বলে গেলেন, ‘তবু একবার ভেবে দেখবেন মাস্টারমশাই।’
আজকের দিনে ভাবা যায়??? হয় বাবা লাশ হয়ে যেতেন, নাহয় বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হত। নিদেনপক্ষে মারধর, অশ্রাব্য গালাগাল কিংবা ধোপা-নাপিত বন্ধ তো হতই। আদর্শের সেই ঋজুতা, বিভিন্ন মতাদর্শ বা ভাবনার মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কীভাবে যেন লোপাট হয়ে গেল। রাগ হবে না? যন্ত্রণা হবে না? ক্ষমতালিপ্সায় যখন যেমন, তখন তেমন দেখলে হাসি পাবে না?