Sunday, May 12, 2024
HomeTop Newsপরিত্যক্ত গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে শীর্ণ মার্জার শাবক

পরিত্যক্ত গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে শীর্ণ মার্জার শাবক

মণিপুরে উত্তরবঙ্গ সংবাদ-২

রূপায়ণ ভট্টাচার্য, ইম্ফল : একটি অতি শীর্ণ বেড়ালছানা দাঁড়িয়েছিল ধ্বংসলীলার মাঝে। অবুঝ বিভ্রান্তের মতো একবার এদিকে যাচ্ছিল, একবার ওদিকে। বৃষ্টিতে জমা জল চাখল সন্তর্পণে। কখনও শুয়ে পড়ল। বহুদিন ধরে খাবার পায়নি ভালো করে।

খাবার কে দেবে? গাছে গাছে ফুল। ফল। কোথাও গোলাপ, কোথাও ডালিয়া, কোথাও বাতাবি লেবু। এত রংয়ের তরঙ্গে শুধু মানুষ নেই কোনও তল্লাটে।  নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধে থাকা গ্রামে অনেকের উঠোনে তুলসীতলা ঢেকে দিয়েছে জংলিগাছ। অনেকদিন ঝাঁট না পড়ায় উঠোন শ্যাওলায় কালো কুচকুচে। বাঙালি হিন্দুদের মতো মণিপুরি মেইতেইদের বাড়িতেও তুলসীতলা বাধ্যতামূলক।

আর কী দেখছি? সর্বত্র ভাঙা টিনের পর টিন। অসংখ্য ছাদহীন ঘর। কম্বল থেকে কলসি, সব পড়ে বারান্দায়। জানলা-দরজা ভাঙা। কোথাও এমন আগুন দেওয়া হয়েছিল যে, অজস্র বড় গাছও ঝলসানো। দোকানপাট, হোটেলে পোড়া দাগ, বালির বাংকার। যাবতীয় ভয়াবহতার মাঝে শুধু বেড়ালছানাটি জীবনের চিহ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শুনসান রাস্তা পেরোয় ধীরে, অতি ধীরে, কৌতূহলী পায়ে। মার্জার শাবকের ছবিটা আজকের মণিপুর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সমতল শেষে পাহাড় শুরু কাংচুপ চিংখং গ্রাম থেকে। একেবারে গায়ে ফায়েং গ্রাম – ভারতের প্রথম কার্বন পজিটিভ অঞ্চল। অতীতের ন্যাড়া পাহাড় গ্রামবাসীদের দৌলতে এখন সবুজে সবুজ। ইম্ফল থেকে রাস্তাটা ১৮ কিলোমিটার এসে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আরও উপরে উঠবে। তিন মাস আগে মেইতেই ও কুকিরা এই গ্রামে পাশাপাশি থাকতেন। আপাতত সেখানে অসংখ্য বাংকারের পিছনে মিলিটারির দল।

ভাঙা তিনতলা বাড়ির দেওয়ালে ইংরেজিতে লেখা মেইতেই শব্দটি। যাতে স্থানীয়রা না ভাঙে। পাশে রাস্তার ব্যারিকেডে আশ্চর্যজনকভাবে লতিয়ে উঠেছে কুমড়োলতা। অনেকদিন হয়ে গেল এখানে কারও পা পড়েনি যে। গ্রামের অন্য প্রান্তে মেইতেইদের রিলিফ ক্যাম্প। মেয়েদের আরও নিরাপদ জায়গায় রেখে পুরুষরা এখানে। সামান্য কয়েকজন নারী রাস্তার ধারে বসে কুকি প্রবেশ ঠেকাতে। অদূরে ডন বসকো স্কুল মিলিটারির আস্তানা।

কুকিদের সঙ্গে ভাইয়ের মতো থাকার দিন আবার ফিরে আসুক, সেটা কি আপনারা চান না? ভিড়ের মধ্যে প্রশ্ন করলে উত্তর এল, ‘জানি না কী চাইব। তবে আর বন্ধুত্ব থাকা মুশকিল।’ বারবার তাঁরা একটা কথায় জোর দিচ্ছিলেন, ‘কুকিরা যে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে, তা ভারত সরকারেরও নেই। এরা নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে এসব পাচ্ছে।’ এখনও যে ওঁরা ভয় পাচ্ছেন বাড়িতে ফিরতে, তার কারণ ওটাই। কখন আবার পাহাড় থেকে আগুনের গোলা ছুটে আসবে!

তাঁদের কথা শুনে ভয় জাগে, এমন শুনসান পরিত্যক্ত গ্রাম আর না জানি কত রয়েছে! গ্রামের অনেক খবরই মিডিয়ার কাছে আসছে না। ধর্ষণের ভিডিও নিয়ে যেমন অনেক পরে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে হইচই হল। ইম্ফল বা চূড়াচাঁদপুর- দু’পক্ষের শিবিরে অনেককে এই একই কথা বলতে শোনা গেল, ‘আপনারা আসলে জানেন না, আরও কোথায় কোথায় বীভত্স অত্যাচার হয়েছে।’

বাতাসে মিশে যাচ্ছে আতঙ্কের লাগামহীন গুজব। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার যা ভয়াবহ দিক। কেউ যাচাইয়ের পথে নেই। দু’পক্ষের রিলিফ ক্যাম্পে গিয়েই শুনতে হল একই অভিযোগ। ‘ওদের কাছে কেন বেশি অস্ত্র?’ মেইতেইরা বলছেন, কুকিদের অস্ত্র দিচ্ছে বিদেশিরা, আসাম রাইফেলস। কুকিদের দাবি, মেইতেইদের অস্ত্র জোগাচ্ছে মণিপুর পুলিশ। চূড়াচাঁদপুর থেকে পশ্চিম ইম্ফল, বিষ্ণুপুর থেকে মায়ানমার সীমান্তের মোড়ে শহর- সব জায়গায় এক ছবি, এক বক্তব্য, এক ক্ষোভ। মেইতেইদের দাবি, কুকিরা মায়ানমার, চট্টগ্রাম, এমনকি ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনে গিয়েও ঝামেলা পাকাচ্ছে। কোথায় মণিপুর, কোথায় প্যালেস্টাইন!

ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাহাড়ি গ্রামে মাকলাং নদীর ওপর ল্যাংদেংবুং ব্রিজ। পাশে জঙ্গলের গায়ে একটি চার্চ মণিপুরের মেইতেইদের সম্পর্কে খুলে দেয় নতুন তথ্য-জানলা। মেইতেই যুবকরা নিয়ে যান সেখানে। ১৮৯৬ সালে মণিপুরের প্রথম খ্রিস্টান অঙ্গম পোরম সিংয়ের বাড়ি। পোরমের নাতিরা গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন মেইতেইদের সঙ্গে। ‘মানুষের ভুল ধারণা, মেইতেইরা শুধু হিন্দু। এটা একেবারে ভুল। অঙ্গম পোরম মণিপুরের প্রথম খ্রিস্টান। তিনিও আমাদের মতো মেইতেই।’ শোনাচ্ছিলেন তরুণরা। বাড়ির মধ্যে অঙ্গম পোরমের সমাধিতে শ্যাওলা লেগে। লেখাগুলো বোঝা যায় না। কলকাতার সাংবাদিক যাতে ভালো ছবি তুলতে পারেন, সেজন্য সেই সমাধি পরিষ্কার করে দিলেন মেইতেইরা।

মেইতেই-কুকি, দুই গোষ্ঠীর ত্রাণশিবিরে কথা বললে কিছু রহস্য পরিষ্কার হয়। কিছু রহস্য অস্পষ্টই থাকে। এত শান্ত, এত নীচু গলায় কথা বলা লোকগুলো আক্রমণের সময় কীভাবে এমন হিংস্র হয়ে যায়? ইম্ফলের চারদিকে, দূরে দূরে ছোট ছোট পাহাড়। সেখানে যত অল্প কুকি থাকুন না, মাঝে মাঝে আক্রমণে এসে উধাও হয়ে যেতে পারে পাহাড়ি জঙ্গলে। মণিপুরে পাহাড়ি অঞ্চল ৯০ শতাংশ, উপত্যকা ১০ শতাংশ। দক্ষিণে মিজোরাম- মিজোরা অধিকাংশ কুকিদের দিকে। উত্তরদিকে নাগাল্যান্ড- নাগারাও কুকিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ৫৩ শতাংশ মেইতেইকে তাই ১৬ শতাংশ কুকিদের ছোবল মারা অনেক সুবিধে। ক্ষিপ্ত মেইতেইরা বরং আটকে দিচ্ছেন প্রধান প্রধান শহরে আসার পথ।

অশান্তির রাজ্যে পা রেখে দুটো কৌতূহল দানা বেঁধেছে খুব। এক, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংও মোদি স্টাইলে নীরব কেন? তাঁকে ধরতেই পারছে না মিডিয়া। সোমবার ঘনিষ্ঠ বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেও মৌনীবাবা। দুই, কুকিদের কাছের মানুষ মেরি কমও চুপ কেন? ৪ মে ‘আমার রাজ্য জ্বলে যাচ্ছে’ বলে টুইট করেছিলেন রাজ্যসভার সদস্য, অলিম্পিক পদকজয়ী মেরি। তাতে ট্যাগ করেছিলেন মোদি, শা, রাজনাথ এবং তিনটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলকে। তারপর অন্তহীন নীরবতা।

কম-দের অনেক মেইতেই কুকিদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে রাখতে নারাজ। ইম্ফলে অনেকে বলছিলেন, কম-রা আদি কুকি হলেও নিজস্বতা বজায় রাখতে চায়। তবে চরম উত্তেজনার মাঝে কে আবার এত তলিয়ে ভাবে? মেরি আবার খ্রিস্টান। ইম্ফলের গেমস ভিলেজ অঞ্চলে মেরির ভাই হাপরেংয়ের বাড়িতে অর্ধেক আগুন দিয়েছিল বহিরাগত মেইতেইরা। স্থানীয় মেইতেইদের আবেদনে পুরোটা জ্বালায়নি। কিন্তু হাপরেংয়ের প্রতিবেশীকে খুন করে বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে যায়। বীরেন এবং মেরির নীরবতা নিয়ে সমালোচকরা বলছেন, এঁরা উদাসীন। ভক্তরা বলছেন, এঁরা সতর্ক।

ঔদাসীন্য এবং সতর্কতার নৌকোয় কত দূর যাওয়া যাবে, প্রশ্ন থাকছেই। যেখানে মণিপুর পুলিশ ও অসম পুলিশের ঝামেলাই তীব্র। টালমাটাল প্রশাসনের রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মতো ইম্ফলের বিজেপি নেতারাও অদৃশ্য। শহরের সুবিস্তৃত কাংলা দুর্গ দেখতে পর্যটক উপচে পড়ে এমনিতে। সেখানেও লোক নেই। অদূরের বিশাল বিজেপি অফিসেও লোক নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রয়াত ১৬০০ সেনার সমাধিক্ষেত্র রয়েছে শহরে। গিয়ে দেখি, প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে চলে গিয়েছেন কেয়ারটেকার। নিরাপত্তারক্ষীরাও গেট টপকে ঢুকছেন। কবরগুলো ঢাকা বিশাল বিশাল ঘাসে। বহুদিন ঘাস কাটা হয়নি। প্রশাসনেরও একই হাল।

গ্রামের ধ্বংসস্তপে যেন জীবনের খোঁজ করছে ছোট্ট বেড়ালছানা

মুখ্যমন্ত্রীর বদলে কিছু নিয়মরক্ষার কথা বলছেন তাঁর বিধায়ক জামাই রাজকুমার। তাও বাড়িতে বসে। আসলে মণিপুরে সব পার্টির রাজনীতিকরাই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। সবাই নয়াদিল্লি ভিত্তিক তদ্বিরের রাজনীতি করে প্রচার নিচ্ছেন কাগজে বা টিভিতে। বীরেনের সমর্থকরা নয়াদিল্লিতে দেখা করবেন মোদি-শা’র সঙ্গে। কংগ্রেস নেতারা দেখা করেছেন সোনিয়া-রাহুলের সঙ্গে। মেইতেই সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মণিপুর ভাগের বিরোধিতা করছে তো কুকিরা নতুন রাজ্যের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। ঘোলাজলে মৎস্য চাষে ব্যস্ত অনেকে।

বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা চংথাম বিজয় ইম্ফলে প্রেসকে ডেকে চাঞ্চল্যকর দাবি তুলেছেন, ‘অন্তত ৪০ জন বিধায়ক পলাতক। এঁদের কোনও উচ্চবাচ্য নেই।’ বাস্তব বলছে, এঁরা আসলে কী করবেন, বলবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। মোদির মতো, বীরেনের মতো।

ভয়, ভয় এবং ভয়। নেতা থেকে মানুষ, সবাই যেন ভয়ের শিকার। ইম্ফল থেকে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক উত্তরে গিয়েছে কোহিমা হয়ে ডিব্রুগড়। দক্ষিণে মিজোরামের লোয়াংলাই। সাঁইত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক চলেছে করিমগঞ্জ, ১০২ নম্বর মায়ানমার সীমান্তের দিকে। সব রাস্তা ইম্ফল শহরতলি ছাড়ালেই ঘিরে ধরছে অন্তহীন শূন্যতা। ফাঁকা। বাস, ট্যাক্সি নেই। সেই শূন্যতার হাত ধরে নিরুদ্দেশ হাঁটছে দিশেহারা মণিপুর। কুকি-মেইতেইদের পরিত্যক্ত গ্রামের শীর্ণ বেড়ালছানার ছবিকে মনে করিয়ে।

Sourav Roy
Sourav Royhttps://uttarbangasambad.com
Sourav Roy working as a Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sud Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL | ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই বধ কেকেআরের, প্লে অফের টিকিট নিশ্চিত কলকাতার

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে হারিয়ে আইপিএলের প্লে অফে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিল কেকেআর(KKR)। এদিনের খেলায় টসে জিতে বোলিং করার...

Asansol | আম কুড়োতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, বজ্রাঘাতে মৃত্যু বিজেপি কর্মীর ছেলের

0
বারাবনি: বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির অদূরে আম কুড়োতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলো এক বিজেপি কর্মীর ছেলের। শনিবার বিকেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে আসানসোলের বারাবনি থানার খড়াবড়...

Maynaguri | অভাবের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নজির কৃতী পড়ুয়ার, উচ্ছ্বসিত গোটা গ্রাম

0
ময়নাগুড়ি : দারিদ্র্যের মাঝেও নজির প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়ার। ময়নাগুড়ি ব্লকের পানবাড়ি এলাকার ভবানী হাই স্কুলের ছাত্রী রুমা রায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৬০ নম্বর পেয়ে...

Siliguri | শিলিগুড়িতে রাতে প্রবল বর্ষণ, কিছু জায়গায় দাঁড়ালো জল

0
শিলিগুড়ি : অবশেষে প্রবল বৃষ্টি শিলিগুড়িতে। যার ফলে ব্যহত হল শহরের রাতের নগর জীবন। মনে করালো নববর্ষের সন্ধ্যে রাতের কথা। আজ রাতে বৃষ্টি হয়েছে...

Darjeeling | দার্জিলিঙে হেনস্তার শিকার সমতলের গাড়িচালকরা, ছড়াচ্ছে ক্ষোভ

0
শিলিগুড়ি: নির্দিষ্ট পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করলেও জরিমানা করছে দার্জিলিং(Darjeeling) ট্রাফিক পুলিশ। পাশাপাশি লালকুঠি, হাওয়া ঘর সহ একাধিক জায়গায় গাড়ির চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে...

Most Popular