প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ ‘ইন্ডিয়া’ বনাম ‘ভারত’ নাম নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। ‘ইন্ডিয়া’ নাম সরিয়ে সরকারি স্তরে ‘ভারত’ নিয়ে আসার জন্য যখন উঠেপড়ে লেগেছে কেন্দ্রীয় সরকার, সেই মুহূর্তে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিদের একাংশ ‘বাংলা’র নামবদল প্রস্তাব কেন গৃহীত হবে না, সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
উল্লেখ্য মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’ বনাম ‘ভারত’ বিতর্ক উস্কে দেয় রাষ্ট্রপতি ভবন৷ আসন্ন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে আগত সমস্ত রাষ্ট্রনেতাদের এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণপত্রে ইংরাজি ভাষায়, ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে লেখা রয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। আর তা থেকেই দেশের সম্ভাব্য নাম বদল নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। এই নিয়ে তীব্র আলোড়ন পড়ে সর্বত্র। কেন্দ্র তথা বিজেপিকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা তো ভারতই বলি। এতে নতুনত্ব কী আছে? ইন্ডিয়া নামে সারা বিশ্ব চেনে। হঠাৎ কী এমন হল?’ এর পাশাপাশি উস্কে গেছে রাজ্যের নাম পরিবর্তন নিয়ে পুরনো বিতর্কও। বলে রাখা জরুরি ২০১৮ সালে রাজ্য বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল করে ‘বাংলা’ রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয় তথা কেন্দ্র সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য তা পাঠানো হলেও, আজ পর্যন্ত তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি মোদী সরকার।
এই প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান সাংসদ, লোকসভা দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘এ নিয়ে (রাজ্যের নাম পরিবর্তন) অবশ্যই কেন্দ্রীয় স্তরে আলোচনা হওয়া উচিত। অধিবেশনের আগে এই বিষয়ে আলোচনা করা হবে দলের সর্বোচ্চ স্তরে।’ সুদীপবাবু এও বলেন, ‘ভারত বনাম ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে যা বলার তৃণমূল সুপ্রিমো তা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। আমাদের রাজ্যের নতুন নামকরণ ‘বাংলা’ করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ইন্ডিয়া বদলে ভারত রাখা নিয়ে জলঘোলা করার চেষ্টা করলেও আজ পর্যন্ত কিন্তু বাংলার বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি কেন্দ্র সরকার।’ দলের বর্ষীয়ান সাংসদ ও আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘রাজ্যের নামবদল নিয়ে কী বলব? এরা তো দেশেরই নাম পালটে দিতে চাইছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও নোটিফিকেশন জারি করেছে কী? রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের সময় কী নোটিফিকেশনে ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি’ লেখা ছিল নাকি ‘ইন্ডিয়া’র? আইনি পরিসরে এ নিয়ে কোনও বিধান নেই৷ অন্যদিকে রাজ্যের নামবদল না করে বরাবর বাংলার প্রতি অবিচারের ধারা বজায় রেখেছে সরকারপক্ষ।’
এই প্রসঙ্গে দলের অন্যতম নেত্রী তথা রাজ্যসভা সাংসদ দোলা সেন বলেন, ‘কেন্দ্র ও রাজ্য – দুটি ইস্যুর মধ্যে বৈপরীত্য থাকলেও তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনার প্রয়োজন। একটি হল রাজ্যের নামবদল, দ্বিতীয়টি গোটা দেশের। একদিকে রাজ্যের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষের জন্য রাজ্যের নাম আজও পালটানো হল না, অন্যদিকে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের জন্য ইন্ডিয়া নামটাই মুছে ফেলতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। কেন বদল এল না বাংলা নামকরণে?’ দোলা সেন এই প্রসঙ্গে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা কোনও ইস্যু? কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে রাজনীতি? আজও দেশের মানুষ ভাল করে দুটো খেতে পায় না, বেকারত্বের হার শীর্ষে, মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে…সে সবের সুরাহা না করেই সব বিষয় থেকে নজর ঘোরাতে ইন্ডিয়া না ভারত হবে, সে তর্জায় মেতে উঠেছে সরকার। লজ্জাজনক!’
দোলা সেনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘এসব কী শুরু হয়েছে? ২৬ টি দলের জোটকে কৌশলগত ভাবে পরাস্ত করতে এতটাই নিম্নগামী সরকার? এত ভয়?’ প্রদীপবাবু জানান, ‘এতদিন রাজ্যের নামকরণে কেন বদল আনেনি সরকার? অথচ বাংলার রাজ্যপাল ঘটা করে রাজ্যের প্রতিষ্ঠান দিবস পালন করছেন! তিনি বাংলার ইতিহাস কিছু জানেন? জুন মাসের ওইদিন বাংলা ভেঙে দু টুকরো হয়। সেটা আমাদের কাছে ঐতিহাসিক ক্ষত৷ না রাজ্যের ইতিহাস, না দেশের ইতিহাস জানে সরকার৷’ কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে ইন্ডিয়া, ভারত সমার্থক। আজ যেহেতু মোদীর বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া শিবির একজোট, তাই এই অভাবনীয় সিদ্ধান্ত। আর কী কী বদল করবেন প্রধানমন্ত্রী? ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’? ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’? এদের অধ:পতন দেখে করুণা হয়। এমনকি আমাদের রাজ্যকেও এরা প্রাপ্য মর্যাদা দিল না।’
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন অধিবেশনে কি দেশের নাম ইন্ডিয়া বদলে ভারত করা সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব পেশ করতে উদ্যোগী মোদি সরকার? যদিও বিশেষ অধিবেশনের কী কারণ, তা এখনও স্পষ্ট নয়। অনেকের দাবি, ‘এক দেশ এক ভোট’ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিল আনা হতে পারে। অনেকের আবার দাবি, মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ হতে পারে। এই প্রেক্ষিতেই জি-২০’র রাষ্ট্রনেতাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণে ভারতের রাষ্ট্রপতির পত্র ঘিরে নতুন জল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এই আবহে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের নামবদলে ‘বাংলা’ পরিবর্তন করার ইস্যুটি পুনরায় গতি পেল।