- আশিস ঘোষ
যাক, ল্যাঠা চুকেই গেল। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরণ জানিয়ে দিয়েছেন, বেকারত্বের মতো সব আর্থিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। ওসব সরকারের কাজ নয়। ব্যাস, হাত ধুয়ে ফেলেছে সরকার। বেকারি মেটানো তাদের দায় নয়। ভরা ভোটের বাজারে এমন অকপট স্বীকারোক্তি বেশ আমোদই দেয়।
অথচ এই দেখুন না, দশ বছর আগে প্রধান সেবক নিজে তাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিতে তাল ঠুকে বলেছিলেন, বছরে তিনি ২ কোটি চাকরি দেবেন। অচ্ছে দিনের খোয়াবে তা বেশ হাওয়া দিয়েছিল মনে পড়ে? তারপর বেশ কিছুটা সময় পরে সে কসরতে কাজ দিল না দেখে শুরু হল রোজগারমেলা। রাজ্যে রাজ্যে হাঁকডাক করে দেওয়া হল চাকরি। তার বেশিটাই নতুন নয়, সরকারি দপ্তরের খালি পদে। সেটাকেও যোগ করে দশ বছরে কুড়ি কোটির কয়েক যোজন দূরে। তাতে কী? মোদি অবশ্য সভায় সভায় দাবি করে চলেছেন, ভারতে কর্মসংস্থান তৈরি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দেশে বেকারত্বের হার ৬ বছরে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। শহর ও গ্রাম, দুই ক্ষেত্রেই বেকারত্ব দ্রুতগতিতে কমেছে।
এরই মধ্যে সদ্যই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪। দেশের তরুণদের হাল নিয়ে সেই রিপোর্ট রীতিমতো উদ্বেগের ছবি তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বেকারির সমস্যা ক্রমেই ঘন হচ্ছে তরুণদের মধ্যে। বিশেষ করে, শহরের শিক্ষিত তরুণদের। তারা বলছে, ২০০০ সালে তরুণদের অর্ধেকই ছিল স্বনিযুক্ত। চাকরি করত ১৩%। বাকি ৩৭% যুক্ত ছিল ঠিকার কাজে। আর ২০২২ সালে স্বনিযুক্ত তরুণ ৪৭%, চাকুরে ২৮%, ঠিকাকর্মী ২৫%।
রিপোর্টের হিসেব বলছে, আগামী দশ বছরে দেশের মোট কর্মীসংখ্যায় আরও ৭০-৮০ লক্ষ তরুণ যুক্ত হবে। তাদের কী হবে? সরকারি মুরুব্বি নাগেশ্বরণ বলেছেন, এত কাজ সরকার দেবে তা মনে করা ঠিক নয়। সব আর্থিক ও সামাজিক সমস্যায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই মানসিকতা বদলাতে হবে। চাকরি দেওয়ার কথা বেসরকারি কোম্পানির।
তবে কি চাকরির গাজরের টোপ দিয়ে তরুণ-তরুণীদের ভোট জোগাড় করাটাই হবে আসল মতলব? কর্মহীন জনসংখ্যার ৮৩% হল তরুণ-তরুণীরা। আরও উদ্বেগের, তাদের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তরে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়ে ৩৫.২% থেকে হয়েছে ৬৫.৭%। পরিসংখ্যান বলছে, নিরক্ষরদের তুলনায় শিক্ষিত বেকার ৯ গুণ। তাছাড়া মজুরি বা বেতন হয় একই রয়েছে নয়তো কমেছে। তাই সরকারি দাবিমতো যতই ভারতের অর্থনীতি উপরপানে দৌড়াক, বাড়বে বেকারি। এর আগে সরকারি হিসেবই জানিয়েছিল, ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে বেকারত্ব।
ভরা ভোটের মরশুমে এমন হাতেগরম একটা রিপোর্ট পেয়ে মোটেই সুযোগ নষ্ট করতে রাজি নয় বিরোধীরা। কংগ্রেস তেড়েফুঁড়ে বলেছে, গোটা দেশ বেকারির বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। পালটা তাদের কথা, তাদের কাছে কর্মসংস্থানের একেবারে নির্দিষ্ট ছক রয়েছে। ক্ষমতায় এলে তারা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন আনবে। ঠিকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেবে। ৫০০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করে প্রতি জেলায় ১০ কোটি টাকা দেবে। কংগ্রেসের গ্যারান্টি, ৩৯ লক্ষ চাকরি, স্টার্টআপের জন্য ৫ হাজার কোটির তহবিল। তরুণদের কাছে কংগ্রেসের বক্তব্য, ভোট দেওয়ার আগে মনে রাখবেন, দশ বছরে কুড়ি কোটি চাকরির বদলে বিজেপির সরকার তরুণদের ১২ কোটি চাকরি ছিনিয়ে নিয়েছে।
বোঝা কঠিন নয়, যে যেমন পারে তাদের মতো করে প্রচারের মশলা তৈরি করবে। সিপিএম বলছে, কর্পোরেট আর হিন্দুত্বের আঁতাত দেশকে অচল করে দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ বাঁচাতে হলে বিজেপিকে হারাতে হবে। তৃণমূলের কথায়, এটাই মোদির গ্যারান্টি। এতদিন ধরে বেলাগাম বেকারির কথা অস্বীকার করে এখন বলছে, বেকারি মেটানো সরকারের কাজ নয়। পুরোটাই জুমলা।
মোদ্দা কথাটা হল, ভোট রাজনীতির ভুলভুলাইয়ায় কোথায় তলিয়ে যাবে বেকারদের কথা। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। আরেকটা পরিসংখ্যান মনে রাখবেন, শেষতম হিসেবে দেশে আত্মহত্যা যারা করেছে তাদের মধ্যে ১৫,৭৮৩ জন বেকার। তিন বছর আগে আত্মঘাতীদের মধ্যে ২৫ শতাংশই ছিলেন দিনমজুর। তারপরেই স্বনিযুক্ত এবং বেকাররা।
মাত্র গত মাসেই গলায় দড়ি দিয়ে বেকারির যন্ত্রণা মিটিয়েছে উত্তরপ্রদেশের কনৌজের ২৪ বছরের তরুণ ব্রিজেশ পাল। রাজ্য পুলিশের চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল। মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেনি সে। আত্মহত্যার আগে সে তার সব সার্টিফিকেট পুড়িয়ে গিয়েছে। সুইসাইড নোটে ব্রিজেশ লিখেছিল, চাকরি না পেলে এইসব ডিগ্রির কী দাম! অর্ধেকটা জীবন নষ্ট করে ফালতুই পড়াশোনা করলাম।