গৌতম সরকার
রাম থেকে ভোট বামে ফিরছে। কী আনন্দ! বামের যত না, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আনন্দ তৃণমূলের। আহা! পদ্মে ছাপ কমবে। তাই রে নাই রে না! ভোটটা যখন বাম থেকে রামে গিয়েছিল, তখন হাহাকার বেশি ছিল তৃণমূলেরই। হায় হায় কী হচ্ছে! বিজেপির ভোট বেড়ে যাচ্ছে। সেই ভোট রাম থেকে বামে ফিরবে কি না, পরের কথা।
আপাতত একটা ধারণা তো তৈরি করা দেওয়া যায়। যাতে বিজেপি চাপে থাকে, সিপিএম খানিক উল্লসিত হয়। সেই ফাঁকে ভোটারদের বিশ্বাস করানো যায়, বিজেপির অচ্ছে দিন শেষ হল বলে। ধারণা সৃষ্টি এখন ভোটের কৌশল। জনমতের কথা সংবিধানের ভারী বইয়ে লেখা থাকুক শুধু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে তৃণমূল বাইরে থেকে সমর্থন করবে। সঙ্গে সঙ্গে হইচই। বিরোধীরা চাপে। বিজেপির লম্ফঝম্প, আহা, কী আনন্দ। বিরোধী জোট ভেঙে ছত্রখান হল বলে।
আচমকা ভোট বাজারে কেন এমন কথা বলতে গেলেন মমতা, তা নিয়ে চর্চার শেষ নেই। কিন্তু ভাইপোকে বাঁচাতে সেটিংয়ের পথ খোলা রাখার ধারণাটা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী মমতা বিরোধীদের! ধারণার খেলা হবে! বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র ওডিশায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, জগন্নাথ দেব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভক্ত। হ্যাঁ, মুখ ফসকেই বলেছেন। তাতে কী! প্রবল হইচই।
ভগবানকেও বিজেপির মোদির গুণমুগ্ধ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। ধারণাটা ছড়িয়ে দেওয়া গেল তো। কী আনন্দ! ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া গেল। ভোটের বাজারে এই সুড়সুড়ির অনেক মূল্য। ছোটবেলায় কেউ শরীরে সুড়সুড়ি দিলে হেসেই মরে যেতাম আমরা। অস্বস্তিও প্রবল হত। ধারণার সুড়সুড়ি তেমনই। অস্বস্তি বাড়িয়ে দাও। চাপে রাখো। দরকারে উসকে দাও। প্ররোচনা সৃষ্টি করো।
সম্বিত মুখ ফসকে বলেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিন্তু মুখ ফসকায়নি। কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন সন্ন্যাসীর নাম ধরে বলেছেন সরাসরি। ব্যাস! একটা পয়েন্ট পেয়ে গেলেন তাঁর বিরোধীরা। মমতা হিন্দুত্ব বিরোধী। তৃণমূল রাজ্যের হিন্দুদের জিনা হারাম করে দিতে চায়। মুসলমানরা মমতার প্রাণ ভোমরা। আর মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী, অনুপ্রবেশকারী। তারা সবসময় হিন্দুদের সর্বনাশ করার তালে থাকে। বাস্তব যাই হোক, এই ধারণাটা তৈরি করে দেওয়া যাক।
খোদ প্রধানমন্ত্রী হইহই করে আসরে নেমে পড়লেন। হিন্দুদের উদ্দেশে আশ্বাস ছড়িয়ে দিলেন, মোদির গ্যারান্টি, হিন্দুদের রক্ষায় ম্যায় হুঁ না। মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়! ওই সন্ন্যাসীদের নামে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য মুখ্যমন্ত্রীর ঝুলিতে আছে মনে হচ্ছে। এটাও ধারণা। কারণ স্বয়ং তিনি কিছু তথ্য দিয়েছেন। ভুল না সত্যি কে জানে! রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তদন্ত করিয়ে আইনি পদক্ষেপ করা মমতার বাঁয়ে হাত কা খেল! তাহলে সেটা করছেন না কেন?
একই প্রশ্ন, তাঁর বাইরে থেকে বিরোধী জোটকে সরকার গড়তে সমর্থন করার কথায়। বাইরে থেকে কেন? সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে হোক বা জোট নিয়ে হোক, আগু-পিছু না ভেবে কাঁচা মন্তব্য করার পাত্রী মমতা নন। ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ ভোটের মরশুমে যখন কিছু বলেন, তার পিছনে থাকে ধারণা তৈরির ছক। সেই ছকটা কী, কে জানে! আবার ছকটা লুফে নিয়ে পালটা ধারণা তৈরির জন্য মুখিয়ে থাকেন অন্যরা। সেটাই হল।
আমাদের বাস সংসদীয় গণতন্ত্রে। আহা, কী আনন্দ! সংসদীয় গণতন্ত্র মানে ভোট। নাগরিকের ভোটাধিকার। সরকার গড়ার মালিক! সরকার পালটানো এক ছাপের কারবার! আহা, কী আনন্দ! জোর করে কেউ যদি আমাদের ভোট দিতে না দেয়, তাহলে কি আনন্দটা থাকে? নন্দীগ্রামের রথীবালা আড়ির মতো কত মানুষ খুন হয়ে যান ভোটের আগে। তাও আনন্দ! আজকাল ভোট মরশুমে অনেক হিসাববহির্ভূত টাকা উদ্ধার হয়। তাও আনন্দ!
কীসের টাকা? আমার-আপনার ভোট কেনার টাকা। সেটা অবশ্য ধারণা। মিছিলে গেলেও টাকা মেলে। ধারণাটা তখন বাস্তবের মাটিতে মেশে। বুকে হাত রেখে আমাদের অনেকে নিজের বিবেককে বলতে পারবে না যে, টাকাটা হাত পেতে নিইনি। টাকা দিয়ে অধিকার কেনা হয়। কীসের সরকার গড়ার কারিগর আমরা! বাস্তবে ক্ষমতা দখলের কারবারে চাকর আমরা। তবু আমাদের কী আনন্দ! হ্যা-লা-লা-লা আমরা পাঁচ পাবলিক মহানন্দে ভোটের লাইনে দাঁড়াই।
ধারণা তৈরি করে দিতে পারলে কাজ সহজ হয়। গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধি চোর হ্যায়। বফর্স কেনায় অর্থ আত্মসাতের ধারণাটা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া গিয়েছিল। অতঃপর রাজীব গদি খোয়ালেন। অন্দর ঘুস কে মারনে কা দম কেওল মোদিকাই হ্যায়। ধারণাটা তৈরি করে দেওয়া গেল ২০১৯-এ। পাকিস্তানকে আমাদের মননে জাতশত্রু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই কবে। বালাকোটে সেই পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা তো আছে শুধু মোদিরই। ধারণাটা পত্রেপুষ্পে পল্লবিত হল! পরিণতি আমাদের জানা।
গোলি মারো জনতার ইচ্ছাকে। জনমত কোনদিকে, তার চেয়ে বড় কথা জনমত তৈরি করো। টাকা দিয়ে, ধারণা দিয়ে। ভোট বাজারে সেটাই সব। তাতে কারও ক্ষতি হলে হোক, সর্বনাশ হলে হোক। এই যে দেখুন না, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী মিলে ২৬ হাজার নিয়োগ বাতিল করল আদালত। কী প্রবল হইচই। কারও কারও ভাবটা এমন যেন, ভোটের আগে পেড়ে ফেলার মোক্ষম সুযোগ হাতের মুঠোয়।
৫ লক্ষ সার্টিফিকেট কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। আহা, কী আনন্দ! ভোট চলাকালীন এত বড় সুযোগ আর কী হতে পারে। দুর্নীতি হয়েছে সবাই জানে। কিন্তু ভাবুন তো, অনেকের তো সৎ পথে, মেধার ভিত্তিতে চাকরি হয়েছিল। কিংবা ওবিসি সার্টিফিকেট প্রাপকদের অনেকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। এখন হরেদরে যোগ্য-অযোগ্য এক বস্তায়। যোগ্যদের হাহাকার, যন্ত্রণা চাপা পড়ে গেল ভোটে ফায়দা তোলার কৌশলের কাছে। আমাদের হ্যা-লা-লা-লা পাবলিকের কাছে ভোটের কী মহিমা!