দেবদূত ঘোষঠাকুর
পূর্বদিকে জলার মধ্য থেকে সবে মাথা তুলছে শহরের দক্ষিণ ও উত্তরকে জুড়ে দেওয়া ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস। পশ্চিমে রেললাইন পেরোলেই অভিজাত বালিগঞ্জ। তার মাঝে শহরের অন্যতম একটি ঘিঞ্জি এলাকা, পিকনিক গার্ডেন। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বহু ভাষাভাষী মানুষের ভিড়ে সরগরম।
উত্তর কলকাতায় ঠিক তেমনই একটা এলাকা বিবেকানন্দ রোডের ধার ঘেঁষা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের মধ্য দিয়ে পথ করে নেওয়া দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট। একদিকে পোস্তা। অন্যদিকে রবীন্দ্র সরণি, গণেশ টকিজ। পুরোপুরি ব্যবসায়ী এলাকা। সব সময়ে পেঁয়াজ-রসুন তো বটেই, ডিজেল-পোড়া মোবিলের গন্ধও নাকে এসে লাগে। বঙ্গভাষী এখানে হাতেগোনা।
পিকনিক গার্ডেন এলাকাটি যদিও বা প্রোমোটারের হাতের ছোঁয়ায় দেশলাই বাক্সের মতো কিছু বহুতল পেয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজ-রসুনের খোসা উড়ে আসা এলাকাটি মোটেই বদলায়নি অর্ধশতকেও। কিন্তু ধান ভাঙতে এই শিবের গীত কেন!
কারণ, কলকাতার ওই দুটি এলাকা থেকেই কলকাতার আধুনিক থিম পুজোর আঁতুড়। সৌজন্যে, এখন অজ্ঞাতকুলশীল দুটি দুর্গাপুজো। পিকনিক গার্ডেনের সুনীলনগর ক্লাব সর্বজনীন আর দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট সর্বজনীন। আর তার পিছনে ছিল দুই শিল্পীর পরিশ্রম আর জেদ। এঁরা হলেন, বন্ধন রাহা আর কমলদীপ ধর।
১৯৮৯ সালে নতুন মোড়কের পুজো অলংকরণ বা থিমকে কলকাতার পুজো-পাগল মানুষের কাছে নিবেদন করেছিলেন শিল্পী বন্ধন। প্রথম দেখাতেই কলকাতার মানুষ আপন করে নিয়েছিলেন সেই আঙ্গিক। প্রতিমা, মণ্ডপ, আলো এবং আবহসংগীত মিলেমিশে একটা প্যাকেজ। ওই অভিনব শিল্পের টানে বালিগঞ্জগামী মানুষও ছুটে গেলেন পিকনিক গার্ডেনে। শুরু হয়ে গেল বন্ধন ও তাঁর থিমের রাজত্ব। পিকনিক গার্ডেন থেকে ঢাকুরিয়ার বাবুবাগান, কসবা শীতলা মন্দির। স্বাধীনতার ৫০ বছর থেকে শুরু করে ভাঁড়ের মণ্ডপ গড়ে নিজেকে মেলে ধরতে থাকলেন বন্ধন। আর ওঁর পাশে থেকে থিমের পতাকা স্বাধীনভাবে নিজেদের হাতে নিলেন সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, তাপস কাঞ্জিলাল, গৌরাঙ্গ কুইল্যা, কিশোর দাসরা।
বন্ধনের উত্থান যেমন দ্রুত হয়েছিল, তাঁর হারিয়ে যাওয়াটাও ঠিক সেইভাবেই। গত চার-পাঁচ বছর কোনও কাজ না পাওয়ায় ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ভাঁড়ের মণ্ডপের স্থপতি। গত বছর একদিন শুনলাম, মানসিক অবসাদে বিছানা নিয়েছিলেন, আর ভালো হননি।
১৯৮৯ সালের প্রথম থিমপুজোর গল্প বন্ধনের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল বারবার। কিন্তু একই জবাব পেয়েছি, আমি ভালো বলতে পারি না দাদা। তুমি বরং অনুব্রতর কাছ থেকে শুনে নাও। এতদিন শুনিনি। এই লেখার জন্য শরণাপন্ন হলাম নাট্যকর্মী অনুব্রত চক্রবর্তীর। ১৯৮৯ সালে ওই পরিবর্তনের পুজোয় অনুব্রত সামলাতেন ব্যাক-অফিস। আমাকে ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে গেলেন ওই পুজো-পাগল মানুষটা, আমাদের ওখানে বিত্তবান মানুষ তখন নেই বললেই চলে। রেললাইনটা পেরিয়ে আদি বালিগঞ্জ, একডালিয়া, সিংহী পার্কের মতো বড় পুজো। আমাদের পাড়ার লোকেরা পর্যন্ত চলে যেত রেললাইন পেরিয়ে
অনুব্রত বলেন, ১৯৮৮-র পুজোর পরে মিটিংয়ে বসলাম। সবারই এক কথা, কিছু একটা করতেই হবে। এগিয়ে এল বন্ধন। সোমনাথ, তাপস, কিশোররা (ওরা সবাই এখন প্রথিতয়শা থিম শিল্পী) হইহই করে উঠল। সবাই আর্ট কলেজের ছাত্র। আমি চাঁদা তোলা, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ আর প্রচারের দায়িত্বে। দুমাস আগে আমরা চারিদিকে ত্রিপল ঢাকা দিয়ে কাজ শুরু করলাম। বন্ধনের নির্দেশে মণ্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হল প্রতিমা। সেইমতো আলোকসজ্জা। আর সেইবারই প্রথম রেললাইন পেরিয়ে ভিড়টা ছুটে এল পিকনিক গার্ডেনে। সুনীলনগর ঠাঁই পেল খবরের কাগজের পাতায়। পুরস্কারদাতারা বারবার এলেন আমাদের পুজোয়। পরে জেনেছিলাম, ওই মণ্ডপসজ্জার নাম থিম।
ওই পুজোতেই উত্থান বন্ধনের। একসময় সুনীলনগর ছেড়ে বন্ধন পাড়ি দিলেন নামী পুজোয়। থিম তৈরি তখন তাঁর পেশা। ওঁর সঙ্গীরাও স্বাধীনভাবে শুরু করলেন পুজোর কাজ। সুনীলনগর ফের হয়ে পড়ল অজ্ঞাতকুলশীল। হারিয়ে গেলেন বন্ধনও।
১৯৯১ সালে কীভাবে দুর্গাপুজোয় তিনি ঢুকে গেলেন তা এখনও পরিষ্কার মনে আছে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের শিক্ষক কমলদীপের। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে গিয়েছিলেন বরোদা। থাকতেন দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে। ছোটবেলা থেকে সরস্বতী ঠাকুরের মণ্ডপ বানাতেন। কমলদীপ বলেন, ‘একটা বিপদে পড়ে দুর্গাপুজোয় জড়িয়ে পড়লাম।‘
শান্তিনিকেতন থেকে কমলদীপ বলেন, ‘আমরা এক বড় শিল্পীর স্টুডিওতে ঠাকুর বানাতে দিয়েছিলাম। পুজোর দুইদিন আগে গিয়ে দেখলাম, আমাদেরটা কিছুই হয়নি। ঠাকুর না গেলে মণ্ডপের ফাইনাল টাচও দেওয়া যাচ্ছে না। সবাই বললেন, তুই এবার কিছু একটা কর। ব্যাস, স্টুডিওতে বসে দিনরাত ধরে প্রতিমার রূপ দিলাম।‘
সেই ঠাকুর পরদিন বিকেলে নিয়ে আসা হল মণ্ডপে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে কমলদীপ এবার নেমে পড়লেন মণ্ডপসজ্জায়। কমলদীপ বলেন, ‘ঠাকুরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মণ্ডপ তৈরি হল। এক বড় প্রতিযোগিতার প্রথম দশে ঢুকে পড়লাম আমরা। এর পরে আরও চার বছর পাড়ার ওই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন প্রচারের আলোর বাইরে থাকা ওই শিল্পী। এরপরে যত পুজো করেছি প্রতিমা আর মণ্ডপ নিজের মতো করে তৈরি করেছি। নিজের ইচ্ছা না হলে শত অনুরোধ, বিশাল পারিশ্রমিকের প্রলোভন ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি। গর্বের সঙ্গে এমনটা বলতে পারেন শুধু কমলদীপ ধর-ই। গত বছর শান্তিনিকেতনের একটি পুজোয় হাত লাগিয়েছিলেন। এবার কিন্তু আর নেই কোনও পুজোর সঙ্গেই।
বন্ধন, কমলদীপের এই প্রচেষ্টার বছর ৩০-৩২ আগে আরেকজন কিন্তু প্রতিমার গতানুগতিক ধারার বদল বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তিনিই বস্তুত কলকাতার থিম পুজোর পথপ্রদর্শক। কুমোরটুলির পাল পরিবারের কেউ এই সাহসটা দেখাতে পারেননি। দেখিয়েছিলেন, উত্তর কলকাতার নামকরা এক কবিরাজ (অবিনাশ কবিরাজ)পরিবারের ছেলে। শিল্পী হবেন বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কুমোরটুলির সুনীল পালের কাছে।
নতুন ভাবনাকে কার্যকর করার জন্য চাইছিলেন একটা মাধ্যম। অশোক গুপ্তকে সেই সুযোগটা করে দিল বাগবাজারের জগৎ মুখার্জি পার্ক। সালটা ১৯৫৯। খাদ্য আন্দোলনে গুলি চালনার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েজনের। সেই পটভূমিকায় দুর্গার প্রচলিত অবয়বকে ভেঙে, নতুন ঘরানার এক প্রতিমা গড়লেন অশোক। একশ্রেণির শিল্পী চরম বিরোধিতা করলেন। কিন্তু দর্শকরা আপন করে নিলেন ওই প্রতিমাকে। সেটাই কলকাতার প্রথম থিম পুজো। কুমোরটুলির গোপেশ্বর পাল একচালা প্রতিমাকে ভেঙে আটচালা করেন। কুমোরটুলির আশ্রিত এক শিল্পী দুর্গার প্রচলিত অবয়ব বদলে ঢুকে পড়লেন দুর্গাপুজোর ইতিহাসে। ঐতিহ্যশালী বাগবাজার সর্বজনীনের গা ঘেঁষা ওই পুজো অশোককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল।
সেই সময় জিতেন পাল, রমেশ পাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপালরা কুমোরটুলি শাসন করছেন। তবে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে শিল্পী হতে চাওয়া নতুনদের ভিড়ও পালেদের স্টুডিওতে কম নয়। অশোক গুপ্তর কর্মশালার কাছে কাছেই যাঁদের দেখা যেত, তাঁদের একজনই এখনকার নামী থিমশিল্পী সনাতন দিন্দা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশোকদার কাজ দেখতাম। একবার গড়ছেন। আবার ভাঙছেন। প্রতিটি ভাঙা আর গড়ায় প্রকাশ পেয়ে যেত শিল্পীর জাত। আর জগৎ মুখার্জি পার্কের ঠাকুর যখন গড়তেন, আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। চোখ ছলছল করছিল সনাতনের।‘
অশোক পরিবর্তন এনেছিলেন কলকাতার পুজোয়। আধুনিকতার মোচড় দিয়েছিলেন। তবে তিনি তখন ছিলেন একা। আর এখন সেই আধুনিকতাকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দিতে লড়াই চলেছে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের। পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের। আর সেই লড়াইয়ে অন্যতম সেনাপতি অশোকের গুণমুগ্ধ সনাতন। ১৯৯৮ সালে হাতিবাগান সর্বজনীনে গণেশ জননী দিয়ে তাঁর থিম পুজোয় হাতেখড়ি। আর জাত চিনিয়ে দিলেন তাতেই। সনাতনের কাজের মধ্যে আজও যেন বেঁচে ওঠেন অশোক গুপ্ত।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। চলবেও।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ঘরের মাঠে জয় দিয়ে আইপিএলের গ্রুপ লিগের যাত্রা শেষ করল দিল্লি…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ মঙ্গলবার বারাণসীর বিজেপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আর…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ পিএসজি ছেড়ে এবার কিলিয়ান এমবাপে পাড়ি দিচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদে। গত সাত…
দার্জিলিং: দার্জিলিংয়ের (Darjeeling) পথে মৃত্যু হল এক বাংলাদেশি পর্যটকের (Bangladeshi tourist dead)। মৃতের নাম শেখ…
গাজোলঃ জল জীবন মিশন প্রকল্পের পাইপ চুরি করতে এসে হাতেনাতে পাকড়াও হল সাত দুষ্কৃতী। দুষ্কৃতী…
চোপড়া: সম্প্রতি জল জীবন মিশন প্রকল্পের অন্তর্গত একটি পাইপ খনন করা হয়। পাইপ পাতার সেই…
This website uses cookies.