বালুরঘাটঃ পিচের রাস্তা ছেড়ে ধুলো ওড়া আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পৌঁছোতে হয় কুশমণ্ডর মহিষবাথান গ্রামে। মুখোশের গ্রাম। গমিরা নৃত্যের গ্রাম। দেবদেবীদের সন্তুষ্ট করতে মুখোশ পরে গমিরা নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। মুখোশ পরলে তাঁদের চেনা দায়।
নির্বাচনে জিততে দেবতারূপী ভোটারদের সন্তুষ্ট করার জন্য প্রতিশ্রুতির মুখোশ পরে নেতাদের নৃত্য দেখতে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষজন। বহু যুগ ধরেই রাজনীতির গমিরা চলছে। পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। মুখোশও খুলে গিয়েছে। এবার মুখ চেনার পালা।
২০০ দিন লোকসভা অধিবেশনে উপস্থিত থেকে এবং ৫৯৬টি প্রশ্ন করে সাংসদরত্ন হয়েছেন সুকান্ত মজুমদার। কিন্তু দেশের সেরা সাংসদ কি বালুরঘাট কেন্দ্রের বাসিন্দাদের সেরা পরিষেবা দিতে পেরেছেন?
নাটকের শহর হিসাবে গোটা দেশ বালুরঘাটকে চেনে। সেই শহরেই বেড়ে ওঠা সুকান্তর। অথচ নাটকের প্রসারে পাঁচ বছরে কিছুই করেননি তিনি। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় স্থানীয় শিল্পীদের সুযোগ পাইয়ে দেওয়া বা জাতীয় স্তরের মঞ্চে বালুরঘাটের শিল্পীদের নাটক পরিবেশনের সুযোগ করে দেওয়া দূরের কথা, একটা আধুনিক মঞ্চও কপালে জোটেনি মন্মথ রায়ের উত্তরসূরিদের।
ধুঁকতে থাকা গঙ্গারামপুরের তাঁত, কুশমণ্ডির মুখাশিল্প বাঁচাতেও সেভাবে এগিয়ে আসেননি সুকান্ত। অথচ সুযোগ ছিল না তা নয়। সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি। দিল্লিতে সব মন্ত্রকেই ভালো খাতির আছে তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাধ্যম ছাড়াই কথা বলতে পারেন। তবুও আশাহত হয়েছেন শিল্পীরা। ভিনরাজ্য বা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরা, বিক্রির ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষণ বা কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এনে আর্থিক সহযোগিতা করা, তাঁদের কোনও দাবিই পূরণ হয়নি। গঙ্গারামপুরের দইয়ের ব্র্যান্ডিংও অধরাই থেকে গিয়েছে।
যোগাযোগের দিক থেকে উত্তরের জেলাগুলির তুলনায় বরাবরই অনেকটাই পিছিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে রেল মানচিত্রে যুক্ত হয় বালুরঘাট। লজঝড়ে তেভাগা আর গৌড় লিংক এক্সপ্রেস এই ছিল জেলাবাসীর ভরসা। বহু আন্দোলন, দাবি জানানো হলেও জেলা থেকে কলকাতা যাওয়ার নতুন ট্রেন মিলছিল না। সেই দাবি পূরণ হয়েছে সুকান্তর হাত ধরেই। বালুরঘাটবাসীকে একজোড়া নতুন ট্রেন উপহার দিয়েছেন তিনি।
তাঁর উদ্যোগে বালুরঘাট থেকে হাওড়া এবং বালুরঘাট থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত দুটি নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। দিল্লিগামী একটি ট্রেনকেও মালদার বদলে বালুরঘাট থেকে চালানোর বন্দোবস্ত করেছেন সাংসদ। তাঁর দৌড়ঝাঁপের ফলেই যে তেভাগা এক্সপ্রেস ঝাঁ চকচকে হয়েছে সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। রেলের আরও দু’-চারটি প্রকল্প নিয়ে তদ্বির করেছিলেন তিনি। ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ গাজোল-হিলি চার লেনের রাস্তার কাজ শুরু হয়নি ঠিকই তবে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বরাদ্দ পেতেও দিল্লিতে দরবার করছিলেন সুকান্ত।
সুকান্তর যা কিছু সাফল্য তা ওই রেলপ্রকল্পভিত্তিক। তার বাইরে বালুরঘাট কেন্দ্রের অন্য বিষয়গুলি নিয়ে সেভাবে মাথা ঘামাননি তিনি। বালুরঘাট আকাশবাণী কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। দীর্ঘদিন থেকেই ধুঁকতে থাকা কেন্দ্রটি কার্যত বন্ধের মুখে। কেন্দ্রীয় সরকারি ওই সংস্থার পুনরুজ্জীবনে কিছুই করেননি সাংসদ। একই দশা বালুরঘাট বিমানবন্দরেরও। দায়ভার চাপানোর রাজনীতি হলেও প্রতিশ্রুতি অনুসারে আজও বিমান নামেনি বালুরঘাটে।
বহু আলোচিত হিলি-তুরা করিডর নিয়েও পাঁচ বছরে এতটুকুও জল গড়ায়নি। হিলিতে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট, সীমান্ত হাট তৈরিতেও দিশা দেখাতে পারেননি সাংসদ। একসময় রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আত্রেয়ী নিয়ে আন্দোলনের ঢেউ। বাঁধ দিয়ে আত্রেয়ী, পুনর্ভবার জল আটকাচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে বর্ষা ছাড়া অন্য সময় কার্যত শুকিয়ে যাচ্ছে দুই নদী। আবার কোনও সতর্কবার্তা না দিয়ে হঠাৎ জল ছাড়ায় এপারে ভেসে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা জমির ফসল। শুধু ওই দুই নদী নয়, আরও কয়েকটি নদীরও কার্যত একই দশা। সমস্যা মেটাতে দুই দেশের শীর্ষস্তরে আলোচনার দাবি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি নিয়ে কোনও হেলদোল দেখাননি প্রভাবশালী সুকান্ত।
কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় সাংসদ সেই দলের হলে উন্নয়নে গতি আসবে। এটাই ছিল ২০১৯-এর প্রচারে বিজেপির যুক্তি। তবে ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি নিয়ে পর্যটন সার্কিট গড়ে পর্যটকদের আকর্ষণের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ দেখা যায়নি সাংসদের। বাণগড়ের খননকাজ পুনরায় চালুর জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পেতে সুকান্ত তদ্বির করেছিলেন ঠিকই, তবে পর্যটনের সার্বিক বিকাশে কেন্দ্রীয় অনুদান এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারেননি।
বিশবাঁও জলে পড়ে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদপুর-কালিয়াগঞ্জ রেল যোগাযোগের কাজও কিছুই হয়নি গত পাঁচ বছরে। ওই রেলপথ তৈরি হলে জেলার মৃতপ্রায় রাইস মিলগুলি প্রাণ ফিরে পেত। হাল ফিরত জেলার আর্থসামাজিক চিত্রে। এক সময় জেলার বিভিন্ন অংশে প্রচুর পরিমাণে সুলি এবং সিটি লংকার চাষ হত। কম ঝাল অথচ রং বেশি- এমন গুঁড়ো লংকা তৈরিতে সিলি ও সুটির ব্যাপক চাহিদা ছিল। একাধিক বহুজাতিক সংস্থা সেই লংকা কেনাও শুরু করেছিল। তবে নানা কারণে মুখ ফিরিয়েছে সংস্থাগুলি। সাংসদ উদ্যোগী হলে লংকা নিয়ে কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ তৈরি হত দক্ষিণ দিনাজপুরে। সেই কাজও কিছুই হয়নি।
করা যেত কিন্তু হয়নি, বালুরঘাটে এমন কাজের বহু উদাহরণ রয়েছে। তবে আপদে-বিপদে সাংসদকে পাশে পাওয়ায় প্রকল্প না পাওয়ার ব্যথা খানিকটা উপশম হয়েছে বালুরঘাটবাসীর। জেলায় যখনই সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই সেখানে হাজির হয়েছেন সুকান্ত। একথা বিরোধীরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে কাউকে দিল্লিতে পাঠানোই হোক বা অন্য কোনও সহযোগিতা, সাংসদের বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরেছেন খুব কম মানুষই।
তবে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত হলেও কার্যত দুয়োরানির দশা হয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহারের। সাংসদ তহবিলের টাকায় কিছু কাজ ছাড়া ওই এলাকায় আর কিছুই হয়নি। ইটাহারের মানুষজন সাংসদকে সেভাবে পাশেও পাননি। কথায় আছে, যে মেঘ গর্জায় সে মেঘ বর্ষায় না। বাস্তবে উন্নয়ন নিয়ে ২০১৯-এ যেভাবে গর্জন করেছিলেন সুকান্ত সেভাবে বর্ষাতে পারেননি।