বালুরঘাট: অত্যাধুনিক যন্ত্রের কাছে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে ঘানির তৈরি সর্ষের তেল। সভ্যতার আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘানিতে ভাঙানো সর্ষের তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ মানুষ ভুলতে শুরু করেছে। ঠিক সেইসময়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই ঘানির সর্ষের তেল তৈরি করে আসছেন বালুরঘাটের দৌল্লা ও পাগলিগঞ্জ এলাকার কয়েকটি পরিবার। যদিও দৌল্লা ঘানি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এমনি মিলের তেলের থেকে ঘানির তেলের দামও অনেকটাই বেশি। দূরদূরান্ত থেকে এই তেল নেওয়ার জন্য ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। আবার বিভিন্ন হাটেও দোকান দেন ব্যবসায়ীরা।
বালুরঘাট ব্লকের পাগলিগঞ্জ এলাকায় একটা সময় গেলেই ভোর থেকেই শোনা যেত ঘানির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। একটা সময়ে এই ঘানিতে তৈরি তেলই ছিল সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা। সর্ষের তেলের ঝাঁজে নাকি চোখে জল এসে যেত ঠাকুমা কিংবা দিদিমাদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার ফলে অত্যাধুনিক মানের তেলের মিল তৈরি হয়েছে। ফলে ঘানিতে তৈরি তেলের তেমন দেখা মেলে না। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই তেল একেবারেই অপরিচিত বললেই চলে। অথচ আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগেও ঘানি সর্ষের তেলের উপরে ভরসা করে থাকতে হত সাধারণ মানুষদের। পাশাপাশি পুরোনো এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সর্ষের তেল পাওয়া যায় তার বিশুদ্ধতা কিংবা মানের দিক থেকে বর্তমান মিলের তেলের তুলনায় অনেক গুণ ভালো বলে দাবি প্রবীণদের।
বংশ পরম্পরায় এই পেশাকে ঐতিহ্য হিসেবে এখনও অনেক কষ্টে তারা টিকিয়ে রেখেছেন ঘানিগুলো। গাছের গুড়ির উপরের ফাঁকা অংশে সর্ষে ঢেলে নীচে একটি বিশেষ আকৃতির ছিদ্রের ভেতর দিয়ে তেল পড়ে পাত্রে। এরপর তা একটি ড্রামে সংরক্ষণ করা হয়। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা খুলু কিংবা তেলি নামে পরিচিত। একবার তেল করতে বের করতে প্রতিটি ঘানির পেছনে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা করে একটি করে গোরু ঘোরে। ঘানি টানার সময় গোরুর চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তবে গ্রামাঞ্চলে এই গোরুর ঘানির সংখ্যা এখন হাতেগোনা।
অত্যাধিক পরিশ্রমের পাশাপাশি লাভের পরিমাণ সীমিত ও সময় সাপেক্ষ হওয়ার ফলে, ঘানিতে তেল তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বহু খুলু বা তেলিরা। তবে বংশ-পরম্পরায় চলে আসা ঘানিতে তেল তৈরি ব্যবসা এখনো ধরে রেখেছে পাগলীগঞ্জ কয়েকজন। শহর সহ আশপাশের গ্রামগুলিতে ঘানি ভাঙা তেলের চাহিদা এখনও প্রচুর রয়েছে। খুলু বা তেলিদের দাবি ঘানিতে ভাঙানোর তেলের চাহিদা বিশেষ করে শীতকালে প্রচুর পরিমাণে হয়ে থাকে।
এবিষয়ে পাগলিগঞ্জের প্রদীপ সাউ বলেন, ‘আগে অনেকে করত। কিন্তু অধিক পরিশ্রমের জন্য আনেকেই এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ১ কেজি তেল বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। সারাদিন কাজ করলে ৫-৬ কেজি তেল বের হয়। সব বিক্রি হলে পরে দিনে আয় হয় ৩০০ টাকার মতো। অধিক পরিশ্রম হলেও লাভের পরিমান খুব কম। বাড়ির সকলেই এই কাজে যুক্ত থাকে। দীর্ঘদিনের পেশা তাই আজও চালাচ্ছি।‘
বালুরঘাটের বাসিন্দা প্রতিমা মণ্ডল বলেন, ‘ঘানির তেল ছোট বাচ্চাদের মাখানোর জন্য খুব ভালো। এমনি তেল ১৩০-১৪০ টাকা কেজি হলেও ঘানির তেলের দাম অনেক বেশি। তাই অনেকে ইচ্ছে থাকলেও ব্যবহার করতে পারে না।‘