রূপায়ণ ভট্টাচার্য, লখনউ: গোমতী নদীকে ডানদিকে রেখে গাছপালা ও পার্কের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেলে পরপর পড়বে লখনউয়ের (Lucknow) চোখধাঁধানো বড়ে ইমামবাড়া (Bara Imambara) ও ছোট ইমামবাড়া (Chota Imambara)। চমৎকার পাথরের রাস্তা। আপনাকে ক্রমাগত সঙ্গ দিয়ে যাবে অসংখ্য গাছপালা।
সকালে রোদ্দুরের মাঝে একেবারে শুনসান। বিকেল থেকে রাত মানুষের ঢেউ। দুই ইমামবাড়ার মাঝখানে বড়টির গাঁ ঘেষে তুরস্কের একটি গেটের আদলে নবাব আসফ-উদ-দৌলা বানিয়েছিলেন অপরূপ রুমি গেট। অনেকে বলে টার্কিশ গেট। তার সংস্কার চলছে নতুন করে। সেখানে ফুটপাথের একজন মধ্যবয়স্ক দোকানদার ভিনরাজ্যের সাংবাদিক বুঝে প্রশ্ন করলেন, আজকের কাগজে মায়াবতীর বিবৃতি দেখেছেন?
মায়াবতী শুধু নন, আজ লখনউ নগরীর সবচেয়ে তিন আলোচিত রাজনীতিবিদের তিনটি খবর শহরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায়। তিনটে মন্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিন প্রধান নেতার মনোভাব আসলে কী। যোগী আদিত্যনাথ গত ৪১ দিনে ১০০টি সভা করেছেন। কাল শেষ সভায় তাঁর মন্তব্য, ‘ইন্ডিয়া ব্লকের নেতারা অ্যান্টি হিন্দু, অ্যান্টি রাম। সনাতন সংস্কৃতিকে গালাগাল দেওয়াই বিরোধীদের ফ্যাশন। এরা ভারতকে ভাগ করে ছাড়বে।’
অখিলেশ যাদব সোমবার কনৌজের গৌরীশংকর মহাদেব মন্দিরে প্রার্থনা করতে গিয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর গেরুয়া বস্ত্রধারী অনেক লোক সেই মন্দির গঙ্গাজলে সাফ করছেন, এমন ভিডিও এখন ভাইরাল। অখিলেশ সেই প্রসঙ্গেই পিডিএ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই পিডিএ’র অর্থ পিছড়ে (অনুন্নত), দলিত ও অল্পসংখ্যক (সংখ্যালঘু)। অখিলেশ বলেছেন, ‘ওঁদের কী ঘৃণার চোখে দেখে, সেটা প্রমাণ হল আবার।’
উত্তরপ্রদেশজুড়ে সনাতন ধর্ম ও পিডিএ নিয়ে এত কথার মাঝে সবচেয়ে নজরকাড়া সিদ্ধান্ত অবশ্য মায়াবতীর। কাল রাতেই বহেনজি তাঁর লন্ডন থেকে এমবিএ পড়ে আসা ভাইপো আকাশ আনন্দকে তাঁর উত্তরাধিকারী ও জাতীয় কোঅর্ডিনেটরের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। মায়ার মন্তব্যও মনে দাগ কাটার মতো। ‘যতদিন না ও পরিণত হচ্ছে, ততদিন ও ওই পদে থাকছে না।’
আকাশ বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণকে অন্য মাত্রায় নিয়ে বলেছিলেন, এটা ‘গদ্দারো কি সরকার’, ‘তাবাহি কি সরকার’, ‘তালিবান কি সরকার।’ পাঁচ মাসের মধ্যে ভাইপোকে সরালেও দাদাকে রেখেছেন মায়া। লখনউ চক্কর দিলে প্রচুর লোককে পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের বিশ্বাস একটাই, সিবিআই ও ইডি’র ভয়ে বিজেপিকে চটাতে চাইছেন না বিএসপি নেত্রী। রাজ্যের পশ্চিমাংশে দলিতদের এলাকায় ভোট হয়ে গিয়েছে কাল। তারপরই মায়ার চালে পদ্মের সঙ্গে সন্ধির চিহ্ন।
লখনউ নিয়ে, রাজনাথ সিংয়ের হ্যাটট্রিকে এমনিতে কোনও চিন্তা নেই বিজেপির। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোনয়নপত্র পেশ করার পরেই শিয়া মুসলিম নেতা ইয়াসুব আব্বাস তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘রাজনাথ একেবারে আলাদা মানুষ। সব সম্প্রদায়ের মানুষ ওঁকে পছন্দ করেন।’ লখনউয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ভুলভুলাইয়ায় ঢোকার সময় বোঝা যায়, শহরে শিয়াদের দাপট কেমন।
মূল অট্টালিকার ছাদে যাওয়ার জন্য ১০২৪টি পথ রয়েছে, ফেরার জন্য নাকি মাত্র দুটো। ওঠার সময় প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে চোখে পড়বে ইরান-ইরাকের দুই প্রয়াত শিয়া নেতা খোমেইনি ও আল খোয়ের ছবি। পরের দেওয়ালে দু’দেশের জীবিত দুই শিয়া নেতা আলি খামেনেই ও আল সিসতানি। নবাবদের আরও দু’পাশে সরিয়ে এঁদের জায়গা করা হয়েছে ভালো জায়গায়। পাশের মিনারে লখনউয়ের দুই শিয়া গুরু পিতা-পুত্রের ছবি। যোগী জমানায় উত্তরপ্রদেশে পুরোনো অনেক কিছু বদল হলেও এখানে হাত পড়েনি এখনও।
এসব শিয়া তো নন, রাজনাথ-যোগীদের মূল অস্ত্র সেই সনাতন হিন্দুরা। জেলায় তাঁদের উপস্থিতি ৭৭.০৮ শতাংশ।
আমিনাবাদে চিরন্তনী চিকনের পোশাকের বাজার দিয়ে অটোতে যাচ্ছি বিখ্যাত টুন্ডে কাবাবের দোকানে। দোকানের প্রায় পাঁচশো মিটার আগে অটো থামিয়ে দিলেন প্রবীণ চালক রামেশ্বর দুবে। ‘আর যাব না। ওদিকে বহু দুর্গন্ধ। ওই আমিষের গন্ধ একেবারে সহ্য হয় না।’ তারপর চমকে দিয়ে পালটা প্রশ্ন, ‘আপনি কি ব্রাহ্মণ? মাংস, মাছ খান কেন? কেন শাকাহারী নন?’ উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে একই অভিজ্ঞতা হয়। জাতপাতের হিসেবনিকেশ সহজে শেষ হওয়ার নয়। কবে থেকে শুনে আসছি এক জিনিস। আজও লোকে স্বচ্ছন্দে সগর্বে নিজেদের ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-রাজপুত-যাদব-দলিত-তপশিলি হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। অজানা লোকের কাছে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই এঁদের।
গোবলয়ের রাজনীতি কেন পঞ্চাশ বছর পিছনে পড়ে রয়েছে, এসব দেখলে বুঝতে সমস্যা হয় না। যোগী আদিত্যনাথ যে লুকোছাপা না করে খুল্লামখুল্লা হিন্দুত্বের পক্ষে বলছেন, তা অধিকাংশ লখনউবাসীর পছন্দ। ১৯৯১ থেকে বিজেপি জিতে চলেছে এখানে। অটলবিহারী বাজপেয়ী পাঁচবার জিতেছিলেন টানা। ১৯৯১ সালে প্রথমবার জেতার সময় পান ৫০.৯০ শতাংশ ভোট। স্বাধীনতার পর প্রথমবার বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত পেয়েছিলেন ৬৯.১৭ শতাংশ। পাঁচের দশকে এখানে দু’বার হেরে গিয়েছিলেন বাজপেয়ী। একবার স্থানীয় বাঙালি পুলিনবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। রাজনাথ সেখানে ভোটের শতাংশ বাড়িয়েছেন গত দু’বার। ৫৪.২৭ থেকে ৫৬.৭০।
আরও একটা কারণ রাজনাথ-যোগীর যুগলবন্দি মোদি-শা’র যুগলবন্দির মতো দুর্ভেদ্য করে তুলেছে লখনউকে। নিরাপত্তা, কঠোর আইনকানুন। কুখ্যাত অপরাধীদের আর দেখা মেলে না রাস্তায়। নবাবি শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হজরতগঞ্জে রাত আটটার সময় কলেজ ছাত্রীরা রাস্তার ধারে বসে আড্ডা দিচ্ছেন জোড়ায় জোড়ায়। ঝলমলে রাস্তাঘাট। ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানে উপচে পড়া ভিড়। ফুটপাথের ছোট দোকানগুলোতেও।
মেট্রো স্টেশনগুলো বিদেশের মতো। ভাড়া বেশি বলে সাধারণ মানুষ বেশি যাতায়াত করে না, রুটটাও অন্যদিকে চলে গিয়েছে। তবে রাজনাথ বুধবারই বলেছেন, ‘আমার লখনউতে চারটে লক্ষ্য থাকছে এবার। মেট্রোর দ্বিতীয় লাইন। ডিআরডিও ল্যাবরেটরি তৈরি, যাতে স্টার্ট আপ হয় লখনউতে। ব্রাহমোস মিসাইল তৈরির কারখানা গড়া। আর একটা আউটার রিং রোড তৈরি।’
আদিত্যনাথ ও রাজনাথ- দুই নাথের রাজত্বই চলবে নবাবের নগরে। উন্নতির পরিসংখ্যান? জিডিপি, জিএনপি, এনআই, এনএনপির মতো কিছু সূচক চান? ও সব না চাওয়াই ভালো। দেশের সব রাজ্যে এখন যা নিয়ম, উত্তরপ্রদেশেও তাই। শাসক ও বিরোধীদের হিসেব না মেলায় চূড়ান্ত বিভ্রান্তি ঘিরে ধরে বারবার। দুই নাথের নগরীতে ভোটের ফল নিয়েই শুধু বিভ্রান্তি নেই।