Friday, September 22, 2023
Homeরাজ্যউত্তরবঙ্গ২ দশক ধরে বিনা পয়সায় শিক্ষকতা করে চলেছেন মহিষকুচির মৃত্যুঞ্জয়

২ দশক ধরে বিনা পয়সায় শিক্ষকতা করে চলেছেন মহিষকুচির মৃত্যুঞ্জয়

সায়নদীপ ভট্টাচার্য, বক্সিরহাট : ভাইপোকে ভর্তি করাতে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয় লাহিড়ি ওরফে মিলন। সরকারি ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম মহিষকুচি নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই সময় দেখেন, স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশো। শিক্ষকের সংখ্যা চার, ক্লাস ঘরের সংখ্যা পাঁচ। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের উপর চাপ বড্ড বেশি। কথায় কথায় তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তারাপ্রসাদ ভট্টাচার্য মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়বাবু তখন ছাত্র পড়িয়ে কিছু রোজগার করেন। পড়ানো তাঁর নেশা। তাই প্রধান শিক্ষকের ডাকে সাড়া দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। এসব ২০০২ অর্থাৎ আজ থেকে ২১ বছর আগের কথা। কিন্তু সেই শুরু। এখনও মৃত্যুঞ্জয়বাবু স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা করে চলেছেন ওই স্কুলেই। এলাকায় তিনি পরিচিত মিলন মাস্টার নামে।

তবে বর্তমানে ওই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৫০ জন হলেও, শিক্ষক রয়েছেন ৫ জন। ওই স্কুলে পড়ুয়া থেকে অভিভাবকদের একমাত্র ভরসা ৬৭ বছরের ‘মিলন মাস্টার’ই। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে ঠিক সকাল ৯টা বাজলেই স্নান সেরে তৈরি হয়ে স্কুলে যান বক্সিরহাট থানার শালডাঙ্গার বাসিন্দা স্নাতক মৃত্যুঞ্জয় লাহিড়ি। সবার আগে স্কুলে গিয়ে ক্লাস ঘরের তালা খোলেন। নিয়মিত অঙ্ক, ইংরেজি ও বাংলার ক্লাস নেন। নেশার টানেই স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা করছেন। ফলে রোজগারের জন্য অন্য আয়ের খোঁজ করতে পারেননি। এখনও প্রাইভেট টিউশন করেই নিজের খরচ চালাতে হয় তাঁকে। বিয়ে করেননি তিনি। একটা সময় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির তরফে তাঁকে পার্শ্বশিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

তবে তাতে যে খুব দুঃখ হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর, এমনটা নয়। বরং ২১ বছর ধরে যে শ্রদ্ধা এবং সম্মান তিনি পেয়েছেন তা যে কোনও সরকারি সম্মানের চেয়ে অনেক বেশি বলে তিনি মনে করেন। অভিভাবকরা তাঁকে মানেন, পড়ুয়ারাও তাঁকে ভালোবাসে। তাই সবার সমস্যা, অভিযোগের সমাধান মূলত তাঁকেই করতে হয়। সহকর্মীরা অবসর নেবেন, কিন্তু তাঁর অবসরের কোনও বয়স নেই। নিতেও চান না। চান মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত পড়িয়ে যাবেন এই স্কুলেই। আর গ্রামবাসীরা চান ভালোবেসে যিনি বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘ একুশ বছর ধরে স্বেচ্ছায় মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করছেন, তাঁকে সরকার কোনওভাবে স্বীকৃতি দিক, সম্মানিত করুক।

ঝড়-বৃষ্টি, কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও স্কুলে আসায় বিরাম নেই স্যরের। ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিল খাওয়ানো থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেওয়া সবই করেন তিনি। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত সাহা বলেন, ‘মৃত্যুঞ্জয়বাবুর আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁকে কোনওভাবে সাহায্য করার। কিন্তু তিনি সেই সহযোগিতা নিতে চাননি।’ আর মিলন স্যরের কথায়, ‘পড়াশোনা করানোটা আমার নেশা। যেহেতু বিয়ে করিনি, তাই ছাত্রছাত্রীরাই আমার পুত্রকন্যাসম। আমি মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত পড়িয়ে যেতে চাই এই স্কুলেই।’

স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সোনালি সাহা বলে, ‘মিলন স্যর আমাদের বাংলার ক্লাস নেন। তাছাড়া স্কুলে উনি আমাদের অভিভাবক। মিড-ডে মিলের সময় উনি আমাদের দেখভাল করেন।’ ওই স্কুলের প্রাক্তন পড়ুয়া তথা অভিভাবক রাজেশ সরকার বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা ওঁর কাছেই পড়াশোনা করেছি। অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। তবে উনি নিঃস্বার্থভাবে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। প্রশাসনের উচিত তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া।’ বক্সিরহাট কলেজের পড়ুয়া শুভঙ্কর দাস বলেন, ‘ছোটবেলায় উনি আমাদের শিক্ষাদান করেছেন। অনেক পুরানো শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। তবে তিনি আজও স্কুলেই শিক্ষকতা করছেন। এককথায় তাঁর মতো মানুষ আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ।’ তাঁর পরামর্শ ছাড়া প্রধান শিক্ষকও একক সিদ্ধান্ত নেন না।  শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে কোচবিহারে নজির গড়া প্রবীণ মিলন ‘স্যর’কে কুর্নিশ জানাচ্ছে স্কুলের পড়ুয়া থেকে অভিভাবক সকলেই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments