Exclusive

Nagen Roy | ভোট-অঙ্কে নগেন যার, জয় তার

শুভঙ্কর চক্রবর্তী, কোচবিহার: ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে/ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া, ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।’

১৯৩৯ সালে আব্বাসউদ্দীন আহমেদের রেকর্ড করা গানটি এখনও মুখে মুখে ঘোরে। ভাওয়াইয়া সম্রাটের জেলা কোচবিহারে এবারের ভোটে ফাঁদের উপর ফাঁদ বিছানো। কার পাতা ফাঁদে কে পা গলাচ্ছে সেই অঙ্ক মেলানো কঠিন।

বলরামপুরে আব্বাসউদ্দীনের বসতভিটে জঙ্গলে ছেয়ে গিয়েছে। তিনি যে ঘরে বসে গান বাঁধতেন, সংস্কারের অভাবে সেই বাঁশ-কাঠের ঘরটিও যে কোনওদিন ভেঙে পড়তে পারে। নেতা, মন্ত্রীরা কথা দিলেও আব্বাসউদ্দীনের বাড়ি অধিগ্রহণ হয়নি। সেখানে তৈরি হয়নি ভাওয়াইয়া গবেষণাকেন্দ্র। তবে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিরিখে এবারে ভোট হচ্ছে না। এবারে কোচবিহারের (Cooch behar) ভোট কৌশলের। তাতে যে কিস্তিমাত করতে পারবে সেই রাজা হবে।

উত্তরবঙ্গে কোচবিহারই একমাত্র জেলা যেখানে চারজন সাংসদ আছেন। তিনজন লোকসভার আর একজন রাজ্যসভার। জেলার দিনহাটা, সিতাই, নাটাবাড়ি, শীতলকুচি, মাথাভাঙ্গা, কোচবিহার উত্তর এবং কোচবিহার দক্ষিণ- এই সাত বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। জেলার তুফানগঞ্জ বিধানসভা আলিপুরদুয়ার এবং মেখলিগঞ্জ বিধানসভা জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের অধীনে। সেই হিসাবে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের সাংসদও কোচবিহারের সঙ্গে যুক্ত।

জেলা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন নগেন রায় (Nagen Roy)। এর উপর জেলায় একজন কেন্দ্রীয় ও একজন রাজ্যের মন্ত্রী রয়েছেন। চার সাংসদ ও দুই মন্ত্রীর জেলায় ভোটে জিততে উন্নয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে সামান্যই।

প্রথম দফার নির্বাচনে কোচবিহার তৃণমূলের কালো ঘোড়া। আসনটি পুনরুদ্ধারে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছে ঘাসফুল শিবির৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ঘুঁটি সাজানো হয়েছে সেভাবেই। দলের ভেতরে ও বাইরে যা সমস্যা তৈরি হবে যেভাবেই হোক তৎক্ষণাৎ সেটি মিটিয়ে ফেলা- এই নীতিতে এগিয়ে বিজেপিকে যথেষ্ট চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল।

সাংসদের পারফরমেন্স, প্রচার, উন্নয়ন, সাংগঠনিক শক্তি সব দিক থেকেই কোচবিহারে পিছিয়ে বিজেপি। তবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভই তাদের ইউএসপি। কোচবিহারে নানা কারণে সেই ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বহু এলাকায় কোনও প্রচার ছাড়াই তৃণমূলকে টেক্কা দেবে পদ্ম শিবির।

দিনহাটার কথাই ধরা যাক। সেখানে নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতার জেরে বিজেপি যতটা ভোট পাবে, তার থেকে অনেক বেশি ভোট পাবে উদয়ন গুহর বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে। শুধু উদয়ন নয়, এরকম জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নেতার কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভোট হবে৷ সেখানে দল, ইস্যু, উন্নয়ন, প্রতিশ্রুতি কোনও কিছুরই গুরুত্ব নেই।

তবে জেলায় যে শুধু তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেই ভোট হবে, তা কিন্তু নয়। বহু জায়গাতেই বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেও ভোট হবে। দিনহাটার বড়শাকদল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তাপস দাস একসময় তৃণমূলের বাহুবলী নেতা ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি দল পালটে বিজেপি হয়েছেন। এখন আবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা পান। তৃণমূলে থাকাকালীন তাপসের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতা, কর্মীদের মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুর ইত্যাদি নানা অভিযোগ ছিল। সেই তাপস কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয় পুরোনো বিজেপি কর্মীরা ব্যাপক ক্ষুব্ধ। এখানকার বিজেপির ভোট কিন্তু পদ্ম প্রতীকে পড়বে না।

কোচবিহারে মূল লড়াই তৃণমূল এবং বিজেপির। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীকে নিয়ে বামফ্রন্টের মধ্যেই মতানৈক্য আছে। সিপিএমের সব ভোট সিংহ প্রতীকে নাও পড়তে পারে৷ আবার তাদের একটা অংশের ভোট যে বিজেপিতে চলে যাবে সে বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ। ফলে বাম-কংগ্রেসের কিছু ভোট পদ্মমুখী হবে।

তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলেরই অভ্যন্তরীণ কোন্দল সমান তালে চলছে। বিজেপির প্রাক্তন জেলা সম্পাদক পর্যায়ের প্রায় হাফডজন নেতা এবং তাঁদের অনুগামীরা এবারে ভোটে ঘরে বসে আছেন। দলের হয়ে প্রচার তো দূরের কথা, সুযোগ পেলেই তাঁরা সামাজিক মাধ্যমে এমন সব কথা বলছেন যাতে বিজেপির ক্ষতি ছাড়া লাভ হচ্ছে না। জেলা বিজেপি নেতাদের অনেকেরই অভিযোগ, জেলা কার্যালয়ের বদলে দল পরিচালিত হচ্ছে নিশীথের বাড়ি থেকে। বিক্ষুব্ধ বিজেপিরা জোট বেঁধে সভাও করেছে। পুরোনো একাধিক গেরুয়া নেতাকেও সেভাবে মাঠে দেখা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে, বাইরে থেকে তৃণমূলকে জেলায় যতটা সংঘবদ্ধ দেখাচ্ছে ভেতরের ছবিটা আদতে ঠিক তেমন নয়। দলের জেলা সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক (হিপ্পি) অভিষেক-ঘনিষ্ঠ। সেই ভয় থেকে প্রকাশ্যে সেভাবে কেউই তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে হাজারবার ভাবে। তবে তলায় তলায় হিপ্পি বিরোধী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এবং সুতো কাটার কাজ শুরু হয়েছে। যদিও অভিষেকের বিশেষ নজরদারির পরোয়া না করে শেষপর্যন্ত গোপনে কে কতটা বিরোধিতার বৈঠা টানতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এবারের ভোটে তৃণমূলের ব্রহ্মাস্ত্র। তার জেরেই মহিলা ভোটারদের কাছে অনেকটাই কদর বেড়েছে মমতার। আর সেই ভোটই তৃণমূলকে ভরসা জোগাচ্ছে।

তবে, এই মুহূর্তে কোচবিহারে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে নগেন রায় (অনন্ত মহারাজ)-এর অনুগামীদের ভোট। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ ভোটের দু’দিন আগেও বিজেপির হয়ে প্রচারে নামেননি। পদ্ম চিহ্নে ভোট দিতেও বলেননি। ফলে নগেনপন্থী গ্রেটারের ভোট কোনদিকে যায় তার উপর এই কেন্দ্রের ফলাফল অনেকাংশেই নির্ভর করছে।

তৃণমূল চাইছে নগেনপন্থী গ্রেটারের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাক। নগেনের সঙ্গে বিজেপির দূরত্বের সুযোগে ওই ভোটের একটা অংশ তাদের দিকে টানতে অনেকটাই সফল হয়েছে তৃণমূল। বংশীবদন বর্মনের অনুগামী গ্রেটাররা তাদের হয়ে জোরদার কাজ করায় রাজবংশী ভোটের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্টেজ পেয়েছে তৃণমূল। জেলাজুড়ে রাজবংশী স্কুল তৈরি এবং সেখানে রাজবংশী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের চাকরি দেওয়ায় রাজবংশী আবেগকে ছুঁতে পেরেছে রাজ্যের শাসকদল।

রাম মন্দির তৈরি করে ধর্মীয় ভাবাবেগের ভোটে বিজেপি নিঃসন্দেহে জেলার একটা অংশে বাড়তি সুবিধা পাবে। তবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি সহ অন্য নেতারা জেলাজুড়ে মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে, যজ্ঞ করে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটেও খানিকটা থাবা বসিয়েছে। আবার মীর হুমায়ুন কবীরের মতন সংখ্যালঘু নেতাদের সঠিক সময়ে মাঠে নামাতেও সক্ষম হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলার পর কর বৃদ্ধি নিয়ে কোচবিহারের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মনে ভয়ও কিছুটা কমেছে। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় কোচবিহারে অনেকটা ভালো জায়গায় রয়েছে তৃণমূল।

তবে পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে বহু এলাকায় মানুষ ভোট দিতে পারেননি। সবক্ষেত্রেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। সেই ক্ষোভ ইভিএমএ পড়বে কি না, তা ভাবাচ্ছে তৃণমূলকে।

সবমিলিয়ে যা পরিস্থিতি তাতে কোচবিহারে কোনও দলকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখা যাচ্ছে না। লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হবে৷ ১৮৮০ সালে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ পাঁচদিনের জন্য শিকারে গিয়েছিলেন। সেই যাত্রায় তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল ‘পেল্কু’ নামে একজন স্থানীয় শিকারি। এবারের ভোটে নগেন সেই পেল্কুর ভূমিকায়। তাঁর ভোট যার সঙ্গে থাকবে শিকার সেই ঘরে তুলবে।

Sushmita Ghosh

Sushmita Ghosh is working as Sub Editor Since 2018. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad Digital. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.

Recent Posts

Ebrahim Raisi | রাইসির মৃত্যুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্র! বিতর্কের মাঝেই মুখ খুলল ইজরায়েল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রবিবার চপার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ইরানের (Iran) প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির (Ebrahim…

7 mins ago

Abhijit Gangopadhyay | মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুমন্তব্য! অভিজিতের প্রচারে ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সম্পর্কে কুমন্তব্য! তমলুকের বিজেপি প্রার্থী তথা…

13 mins ago

Srijan Bhattacharya | সুজন চক্রবর্তীর পর সৃজন ভট্টাচার্য! যাদবপুরের বাম প্রার্থীর প্রচারে ইটবৃষ্টি

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য (CPIM Srijan Bhattacharya) প্রচারে হামলা। মঙ্গলবার…

24 mins ago

Teesta River | লোনাক বিপর্যয়ে পলি পড়ে তিস্তাগর্ভ দেড় মিটার উঁচু, বিপদের শঙ্কা

পূর্ণেন্দু সরকার, জলপাইগুড়ি: গত বছর সিকিম বিপর্যয়ে (Sikkim Disaster) সমতলে তিস্তাগর্ভ দেড় মিটার উঁচু হয়েছে।…

34 mins ago

Indian railways | বিনা টিকিটের যাত্রী ধরতে বিশেষ পরিকল্পনা উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের

শিলিগুড়ি: বিনা টিকিটের যাত্রী ধরতে বিশেষ পরিকল্পনা নিল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল। এবার থেকে চলন্ত ট্রেনের…

1 hour ago

Traders Protest | পুনর্বাসনের দাবিতে অবস্থান বিক্ষোভে ব্যবসায়ীরা

ফালাকাটা: বন্ধ থাকা ফালাকাটা-সলসলাবাড়ি নির্মীয়মাণ মহাসড়কের কাজ ভোটের পরেই শুরু হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে…

1 hour ago

This website uses cookies.