কোচবিহার: ‘শেষ হিসাব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে এল, এবার/ সময় হল হিসাব নেবার।’
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর ভেটাগুড়ির (Bhetaguri) বিট্টু এখন কার্যত রাজপুত্তুর। সন্ধ্যা নামলেই যে গ্রামে শিয়ালের ডাক শোনা যায় সেই খারিজা বালাডাঙ্গা থেকে তাঁর চেয়ার চলে গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র ঠিক পাশে। দেখা হলেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন। দিল্লির দরবারে তাঁর অবাধ বিচরণ। শচীন তেন্ডুলকার, শাহরুখ খানদের সঙ্গে বসে তিনি খেলা দেখেন। বিট্টু আর সেই বিট্টুটি নেই, তিনি এখন নিশীথজি। দিল্লির বাঙালি অফিসারদের প্রামাণিকবাবু।
গত পাঁচ বছরে সিঁড়ি বেয়ে অনেকটাই উপরে উঠেছেন নিশীথ প্রামাণিক (Nisith Pramanik)। কিন্তু যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিল্লি পাঠালেন তাঁরা কী পেয়েছেন? কোচবিহারের (Cooch Behar) জন্য কী করতে পেরেছেন নিশীথ? ভোটের আগে সেই হিসেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলানো শুরু হয়েছে। হালখাতা এলেই যেমন দেরাজ থেকে হিসেবের খাতা বের করা হয় ঠিক তেমনই।
আর পাঁচজন সাংসদের মতো নিশীথও সাংসদ তহবিলের বরাদ্দ অর্থ পেয়েছেন। তা দিয়ে টুকটাক কিছু কাজ যে হয়নি, তা নয়। যেমন ধরুন নিউ কোচবিহার রেলস্টেশনে সাংসদ তহবিলের অর্থে চলন্ত সিঁড়ি, লিফট তৈরি হয়েছে। যাত্রীদের সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়েছে। দু’চারটে রাস্তা, স্কুলের প্রাচীর তৈরি, অ্যাম্বুল্যান্স প্রদান- যেসব গতে বাঁধা কাজ সব সাংসদ করেন, নিশীথও করেছেন। তবে তিনি তো যে-সে সাংসদ নন, দুটো দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি অমিত শা’র ডেপুটি। তাই তাঁর কাছে জেলাবাসীর চাহিদাও অনেক বেশি ছিল।
থাকবে নাই বা কেন? ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় প্রচারে প্রতিশ্রুতির ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন নিশীথ। দু’বছর পর ২০২১-এর বিধানসভার ভোট প্রচারেও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতির কথা। তাঁর সমর্থনে কোচবিহারে বসে অমিত শা’র ফিরিস্তির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। কী ছিল না তাতে? কোচ রাজাদের নারায়ণী সেনার আদলে আধাসেনায় ‘নারায়ণী ব্যাটালিয়ান’ তৈরি, ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজবংশী সাংস্কৃতিককেন্দ্র, চিলারায়ের নামে আধাসেনার প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি, মদনমোহন মন্দির, কামতেশ্বরী মন্দির, পঞ্চানন বর্মার জন্মস্থল নিয়ে জাতীয় স্তরের পর্যটন সার্কিট তৈরির মতো আরও কত কী। তবে এসবের কিছুই হয়নি। নটে গাছটি মুড়োল’র মতো ভোট ফুরোতেই প্রতিশ্রুতির ফাইলে দড়ি বাঁধা হয়েছিল। প্রকাশ্যে না বললেও বিজেপি নেতাদের একাংশ অবশ্য সেকথা অস্বীকার করছেন না।
নিশীথের সাফল্যের খতিয়ানের তালিকায় কিছুদিন হল ঘুরেফিরে একটি প্রকল্পের কথাই উঠে আসছে- নিউ কোচবিহারের স্পোর্টস হাব। ঢাকঢোল পিটিয়ে হাবের শিলান্যাস হয়েছিল। ২০২৪-এর মধ্যেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করে সেখানে প্রশিক্ষণ শুরুর নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন মন্ত্রী। প্রশিক্ষণ দূরের কথা, বাস্তবে সীমানা প্রাচীর তৈরি ছাড়া হাবের কোনও কাজই হয়নি। কোচবিহার থেকে বিমান চালুর কৃতিত্বও রাজ্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়েছে নিশীথকে।
লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশার ভয়াবহ ছবিটা করোনার সময় প্রত্যক্ষ করেছেন জেলাবাসী। কোভিডের সময় কর্মহীন মানুষের হাহাকার আর চোখের জল দুর্ভিক্ষের কথা মনে করিয়েছিল। সব মহলের মানুষেরই অভিযোগ, সেই কঠিন দিনগুলিতেও যেভাবে সাধারণ মানুষ সাংসদকে পাশে চেয়েছিলেন সেভাবে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়াননি।
তাহলে কি পাঁচ বছর ধরে সংসদে কাজের চাপে নিজের এলাকায় নজর দিতে পারেননি নিশীথ? লোকসভার তথ্য কিন্তু তেমন কথা বলছে না। সোমবারই প্রকাশিত হয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস এবং ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচে সাংসদের পারফরমেন্স রিপোর্ট। পাঁচ বছরে লোকসভার অধিবেশনে কোন সাংসদ কতদিন উপস্থিত ছিলেন, কতগুলি প্রশ্ন করেছেন সেই তথ্যও প্রকাশ্যে আনা হয়েছে রিপোর্টে। রিপোর্ট অনুসারে গত পাঁচ বছরে মোট ২৭৩ দিন লোকসভার অধিবেশন বসেছে। তাতে মাত্র ৯২ দিন (৩৩.৭%) উপস্থিত ছিলেন নিশীথ। প্রশ্ন করেছেন মাত্র ৪৯টি। সেই নিরিখে তালিকায় নিশীথের জায়গা হয়েছে ৪৯৩ নম্বরে।
নিশীথের সহকর্মী বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদার ৫৯৬টি প্রশ্ন করে তার নিরিখে দেশের সেরা সাংসদ হয়েছেন। সেখানে নিশীথ কার্যত ডাহা ফেল। এই ফেল করা সাংসদকে কোচবিহারের মানুষ এবার পাশ করাবেন কি না, তা কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন।