শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি : বাংলায় একটা চালু প্রবাদ আছে, ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার।’ দার্জিলিং হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দশা হয়েছে ঠিক সেরকমই। আজও তৈরি হয়নি কাউন্সিল। নেই উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষানিয়ামক, অর্থ আধিকারিক, শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী কেউই। কার্যত কাগজে-কলমেই অস্তিত্ব রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর এই পরিস্থিতিতে এবার ভর্তিও বন্ধ হয়ে গেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। চলতি বছর ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই স্নাতকোত্তরে ভর্তির পোর্টাল খুলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা দপ্তর। ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা হয়েছিল। যেহেতু কোনও আধিকারিক নেই তাই হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পোর্টালই খোলেনি। যার দরুন পড়ুয়াশূন্য হওয়ার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়। পরিস্থিতি যা তাতে আগামী বছর জুলাইয়ের পরে হিল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনও পড়ুয়া থাকবে না। সবমিলিয়ে রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের সংঘাতে অন্ধকারে হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ। ক্ষোভ ছড়াচ্ছে পাহাড়জুড়ে।
২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে সরকারিভাবে চালু হয়ে যায় হিল বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, পরীক্ষানিয়ামক, অর্থ আধিকারিকই হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়তি দায়িত্বে রয়েছেন। চলতি বছর মার্চ মাসে তিন মাসের জন্য হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য হিসাবে প্রেম পোদ্দারকে নিযুক্ত করেন রাজ্যপাল। তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি হয়নি।
ফলে জুনের শেষ দিক থেকে উপাচার্য পদ ফাঁকা আছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে রেজিস্ট্রারহীন। নেই অর্থ আধিকারিকও। সবেধন নীলমণির মতো একমাত্র আধিকারিক হিসাবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষানিয়ামক দেবাশিস দত্ত বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার বিষয়গুলি দেখভাল করছেন। তবে তাঁর হাতে ভর্তির কোনও ক্ষমতা নেই। ফলে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব হয়নি।
দেবাশিস জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টি তাঁরা শিক্ষা দপ্তর ও রাজ্যপালকে জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ হয়নি। তাঁর কথা, ‘উপাচার্য নিযুক্ত না হলে সমস্যা কোনওভাবেই মিটবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই উপাচার্য নিয়োগ করা না হলে ভর্তির পোর্টাল খোলার জন্য বাড়তি সময়ও পাওয়া যাবে না। ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম মেনেই কাজ করতে হবে। দেরিতে উপাচার্য পেলে কারও কিছু করার থাকবে না।’ উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল সূত্রের খবর, হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ (১৬২ জন ছাত্রছাত্রী) ইতিমধ্যেই চতুর্থ সিমেস্টারের (চূড়ান্ত সিমেস্টার) পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের ফলাফল প্রকাশিত হবে। আগামী বছর জুলাই-অগাস্ট মাস নাগাদ দ্বিতীয় ব্যাচ চতুর্থ সিমেস্টারের পরীক্ষা দেবে। সেক্ষেত্রে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি না হলে জুলাইয়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াশূন্য হয়ে যাবে।
উপাচার্য নিয়োগের রাশ আপাতত সর্বোচ্চ আদালতের হাতে। উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য, রাজ্যপাল দু’পক্ষকেই সতর্ক করেছে আদালত। ফলে বিচারপতিরা প্রয়োজনীয় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে রাজ্যপাল অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করবেন না বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। উচ্চশিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, সার্চ কমিটি গঠন করে উপাচার্য নিয়োগ সময়সাপেক্ষ। মাঝে পুজোর ছুটি আছে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরের আগে উপাচার্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। আর সেই সময় আইন মেনে স্নাতকোত্তরে ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে হিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াশূন্য হওয়া সময়ের অপেক্ষামাত্র। সম্ভবত এটাই দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হতে চলেছে যেখানে একজনও পড়ুয়া পড়াশোনা করবে না।
মংপুর আইটিআই কলেজে প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালুর কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত সেখানে একটিও ক্লাস হয়নি। ইংরেজি, নেপালি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিত ও সাংবাদিকতা এই ছয়টি বিষয়ে শুধুমাত্র স্নাতকোত্তর স্তরে দার্জিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়মিত হচ্ছে না বলেই অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্দশা নিয়ে সরব হয়েছেন জিটিএ’র চিফ এগজিকিউটিভ অনীত থাপা থেকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুং সকলেই। অনীতের কথা, ‘হিল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। বহুবার নানা আলোচনা হয়েছে। আমরা সবরকম চেষ্টা করেছি। রাজ্য সরকার ও রাজ্যপাল উভয়পক্ষকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। যা হচ্ছে সেটা কাম্য নয়।’ বিমল গুরুংয়ের বক্তব্য, ‘পাহাড়ের মানুষের আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে। রাজ্য সরকার বরাবরই হিল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উদাসীন। শুধু ঘোষণা করে দিয়েই কাজ শেষ করেছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামব।’ সরব হয়েছেন হামরো পার্টির সভাপতি অজয় এডওয়ার্ডও। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের স্বার্থে হিল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সবার একসঙ্গে রাস্তায় নামা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে পরিকাঠামো তৈরি করে উপাচার্য সহ প্রতিটি পদে নিয়োগ করে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় চালুর দাবিতে এবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন হবে।’