দার্জিলিং

পাতা তুলতে তুলতে সমস্যা শোনেন পঞ্চায়েত সদস্য

মহম্মদ হাসিম, নকশালবাড়ি : বারাইতি নাগাসিয়া মণিরাম গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বেলগাছি চা বাগানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তবে সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে দুপুরের আগে পঞ্চায়েতের কাজে হাত দিতে পারেন না বারাইতি। কারণ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, বাগানের কাজ সেরে তবে তিনি সময় পান পঞ্চায়েতের কাজকর্ম করার। নাহলে বাগানের হাজিরা কাটা যাবে যে!

ক্ষমতায় আসার কত দিনের মধ্যে কোন নেতার আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, কে কত বড় বাড়ি বানিয়েছে আর কে কটা গাড়ি কিনেছে, এসব নিয়ে তো চর্চা সংবাদমাধ্যমজুড়ে। সেসব থেকে একদম ১৮০ ডিগ্রি উলটোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বারাইতি। তিনি কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্য। এমন পদে থাকলেই তো বাড়িতে ঠিকাদারদের আনাগোনা, টাকার প্রস্তাব এসব স্বাভাবিক। তবে বারাইতির অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া একচিলতে ঘরে এসবের বালাই নেই। তিনি সংসার চালান চা বাগানে শ্রমিকের কাজ করে। আর যদি কোনওদিন তিনি বাগানের কাজ ছেড়ে গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে যান, তবে তাঁর অর্ধেক হাজিরা কেটে নেওয়া হয় বাগান থেকে।

ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চা বাগানে শ্রমিকের কাজ। তার পরে পঞ্চায়েতের। নকশালবাড়ি ব্লকের ওই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রতিদিন এভাবেই কাটে। ভোরবেলা উঠেই প্রথমে বাড়ির কাজ। তারপর অর্ধেক দিন বাগানে আর অর্ধেক দিন নিজের এলাকার বাসিন্দাদের সমস্যা সমাধানে কেটে যায়। আবার দলের মিটিং-মিছিল থাকলে সেখানেও ছুটতে হয়।

বারাইতি এখানকার মেয়ে নন। সেই কবে, প্রায় দু’দশক আগে বিবাহসূত্রে বেলগাছি বাগানে আসা তাঁর। আঠারো বছর আগে ফাঁসিদেওয়া ব্লকের গঙ্গারাম চা বাগানের মেয়ে বারাইতির বিয়ে হয় বেলগাছি চা বাগানের বেল লাইনের বাসিন্দা  দিলীপ নাগাসিয়ার সঙ্গে। টাকা ছিল না, তাই দশম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি। তার পরে পরেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী, এক ছেলে, এক মেয়ে, শাশুড়ি ও দুই ননদকে  নিয়ে সাতজনের পরিবার তাঁর।  ছেলেমেয়ে দুজনেই একটি বেসরকারি স্কুলে দশম ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী দিলীপ বেলগাছি প্রাথমিক স্কুলের অস্থায়ী কর্মী। তাঁর খানিক উপার্জন আছে বটে, তবে সংসারের অনেকটা ভারই বছর তেতাল্লিশের বারাইতির কাঁধে।

তিনি বেলগাছি চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। প্রতিদিন ২৩২ টাকা হাজিরা। তা দিয়ে ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন, বৃদ্ধ শাশুড়ির ওষুধপত্র, সাতজনের সংসারের সব খরচ চালাতে হয়। যদি কোনওদিন দলীয় কাজে বা পঞ্চায়েতের কাজে বাগানের কাজে যেতে না পারেন, মাইনে কাটা যায়। উপরি পাওনা ম্যানেজারের ধমক। অর্ধেক দিন কাজ করলেও বাগান কর্তৃপক্ষের চোখরাঙানির সামনে পড়তে হয়।

বেলগাছি পেরিয়ে চেঙ্গা বস্তির কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল পিঠে ব্যাগ নিয়ে চা পাতা তুলতে ব্যস্ত বারাইতি। কাছে গিয়ে কথা বলতেই পাশ থেকে বাগানের সর্দারের ধমক শোনা গেল। দ্রুত চা পাতা তুলতে বলছেন সর্দার। শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্যা হয়ে ধমক শুনতে হয়? মৃদু হাসলেন বারাইতি। চা পাতা তুলতে তুলতেই বললেন, মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। মানুষের কাজ করতে হবেই। আবার এটা আমার রুজি। এটাও তো করতে হবে। তাঁর কথায়, অনেক বাগানেই পঞ্চায়েত সদস্যদের ছাড় দেওয়া হয়। আমাদের বাগানে দেয় না।

জনপ্রতিনিধি হলেও বাগানের কাজ ছাড়ার কথা ভাবতেও পারেন না বারাইতি। বললেন, পঞ্চায়েত থেকে যে ভাতা পাই, তা দিয়ে সংসার চলবে না। তাছাড়া এই পদ চিরদিন থাকবে না। শেষে আমাদের বাগানের কাজেই ফিরতে হবে। এদিকে, বাগানের কাজ ঠিকমতো না হলে সর্দারের ধমক। আবার এলাকার মানুষের জন্য পরিষেবায় কোনও ত্রুটি হলে, তাঁদের কটুকথা। দুদিকেই ভারসাম্য রেখে চলার চেষ্টা করেন বারাইতি।

তাঁর সঙ্গেই বাগানে পাতা তুলতে ব্যস্ত ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ইরি নায়ো, কীর্তি বড়াইকরা। তাঁরা জানালেন, আগের পঞ্চায়েত সদস্যদের এলাকায় খুঁজে পাওয়া যেত না। বারাইতি কিন্তু সবসময় পাশে থাকেন। তাঁদেরই একজন পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার একটা বড় সুবিধার কথা জানিয়ে দিলেন কীর্তি। বললেন, আগে আগে অটোভাড়া দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়ে অফিসে যেতে হত কোনও কাজের জন্য। এখন আর তার দরকার হয় না। ঘরের কাছেই পঞ্চায়েত সদস্য।

বারাইতির সাহস, তাঁর পরিশ্রমের প্রশংসা শোনা গেল বাগানের সর্দার ভৈর ধানওয়ারের মুখেও। স্ত্রীর ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত আগে নাপসন্দ ছিল স্বামী দিলীপ নাগাসিয়ার। এখন মত বদলেছেন। বলছেন, এলাকায় ১৮০০ ভোটার রয়েছে। তাদের সব সমস্যা নিয়ে যেমন ও ব্যস্ত থাকে, তেমনই আবার পরিবারকেও সময় দেয়।

বাগানে কাজ করার সময় আমরা, মহিলারা একসঙ্গে থাকি। তখনই তো জানতে পেরে যাই, কার কী সমস্যা। সাধ্যমতো সেসব মেটাবার চেষ্টা করি, বলতে বলতে পরিশ্রমের মধ্যেও বারাইতির মুখের হাসি মোছে না।

Sourav Roy

Sourav Roy working as a Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sud Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.

Recent Posts

পাম্প হাউস থাকলেও পৌঁছোচ্ছে না জল, ক্ষোভ বাসিন্দাদের

নাগরাকাটা: গ্রামে পাম্প হাউস থাকলেও জল পৌঁছোয় না একাধিক এলাকায়। ক্ষোভে এলাকার বাসিন্দারা সেই পাম্প…

21 mins ago

একমাত্র চিকিৎসক ছুটিতে, বন্ধ প্রাণী স্বাস্থ্যকেন্দ্র

রাঙ্গালিবাজনা: মাত্র একজন চিকিৎসকই ভরসা। নেই কোনও সহকারী। চিকিৎসক ছুটিতে গেলে বন্ধ থাকে আলিপুরদুয়ার জেলার…

46 mins ago

Oklahoma tornado | ওকলাহোমায় টর্নেডোতে মৃত ৪, আহত শতাধিক

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় টর্নেডোতে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কায়…

48 mins ago

Abhishek Banerjee | ‘যোগ্য চাকরিপ্রাপকদের পাশে আছি’, সুপ্রিম শুনানির পর বার্তা অভিষেকের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: 'মেধাযুক্ত যোগ্য চাকরিপ্রাপকদের পাশে আছি', সুপ্রিম কোর্টে চাকরি বাতিলের মামালার প্রথম…

53 mins ago

Skin Cancer | বিশ্বে আসতে চলেছে ত্বকের ক্যানসারের ভ্যাকসিন, মানবদেহে চলছে ট্রায়াল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মাঝেমধ্যেই আমাদের ত্বকে কমবেশি র‌্যাশ, ঘামাচি দেখা দেয়। কখনও হয়তো এসবে…

56 mins ago

Kaliyaganj TMC | তৃণমূল কর্মীর ওপর চাকু নিয়ে হামলা! অভিযুক্ত বিজেপি

অনির্বাণ চক্রবর্তী, কালিয়াগঞ্জ: ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল কালিয়াগঞ্জ (Kaliyaganj TMC)। এক তৃণমূল…

1 hour ago

This website uses cookies.