প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ ঝাঁ চকচকে গ্যালারি, দামি আলোয় ঝলমলে করিডর, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া সর্বত্র৷ তবু মন ভরাতে ব্যর্থ মোদি সরকারের ড্রিম প্রজেক্ট নয়া সংসদ ভবন৷ মঙ্গলবার দুপুরে সেন্ট্রাল হল থেকে সদলবলে পায়ে হেঁটে নতুন ভবনে যখন প্রবেশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ‘হর হর মোদি’ ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে মনে হচ্ছে সংসদ ভবন নয়, নয়া রামমন্দির গঠিত হল লুটিয়েনে। বিজেপির ঢক্কানিনাদ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে সংবিধান হাতে ভবনে প্রবেশ করলেন কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা অধীর চৌধুরী, পাশাপাশি রাহুল গান্ধি, গৌরব গগৈ, জয়রাম রমেশ, মল্লিকার্জুন খড়গে, কেসি বেণুগোপালের মতো শীর্ষ নেতারা। আরও বেশ কিছুটা সময় নিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন সংসদে পা রাখেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, মালা রায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়রা। সকাল থেকে সংসদ চত্ত্বরে বিরোধী শিবিরে চাপা গুঞ্জন ওঠে, কেমন হয়েছে নতুন সংসদ? প্রত্যাশাপূরণ হবে তো? দুপুরে নতুন সংসদ ভবনে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ হওয়ার পর সদনের কাজ মুলতুবি হলে, সংসদীয় অলিন্দে পা রেখে নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করতে শোনা যায় বহু বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের প্রতিনিধিদের।
বর্ষীয়ান আরএসপি সাংসদ এন কে প্রেমচন্দ্রণ জানান, ‘পুরনো সংসদ ভবনই মনে হয় ভালো ছিল। সেই চেনা আমেজ কোথায়? শুধুই আলো আর প্রযুক্তির রোশনাই।’ তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ের মতে, ‘এটা সংসদ নাকি মাল্টিপ্লেক্স? মনে হচ্ছে কোনও পিভিআরে সিনেমা দেখতে আসা হয়েছে৷ মন:পূত হয়নি একটুও।’ একই হতাশা ধরা পড়ল কংগ্রেস সাংসদ হিবি ইডেনের কণ্ঠে। ‘যারা পুরনো সংসদ ভবনে ঘর করে এসেছেন, তাদের কাছে এই সংসদ নিরাশাজনক। পুরনো সংসদ ভবনে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যে মিশেল, মোদি সরকারের ঝাঁ চকচকে আলোয় ঝলমলে সংসদে তার রত্তিমাত্র খুঁজে পেলাম না’ – জানিয়েছেন হিবি৷ ডিএমকে নেত্রী কে সুমতি জানাচ্ছেন, ‘আমি তো হারিয়েই গেছিলাম প্রায়। কোথায় ঢুকে, কোথায় বেরিয়ে যেতে হয় বুঝতে পারছিলাম না। মাথা ভনভন করছে।’
নব্যনির্মিত সংসদ ভবন শুধু জাঁকজমকপূর্ণ, বিলাসবহুলই নয়, অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তিতেও যথেষ্ট ঋদ্ধ। প্রথমবার নতুন ভবনে লোকসভার অধিবেশন শুরু হলে, মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে সংসদের সাপ্লিমেন্টারী বিজনেস লিস্ট কেন বিরোধীদের দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন কংগ্রেসের সাংসদরা৷ আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘোয়াল বার বার বলেন, প্রত্যেক সাংসদ ডেস্কের সঙ্গে সংযুক্ত ছোট এলসিডি মনিটরে তা আপলোড করা আছে, বোতাম টিপলেই তা দেখা যাবে। কিন্তু সেই অত্যাধুনিক প্রক্রিয়া রপ্ত করতে গিয়ে নাজেহাল হন অধীর চৌধুরী, টি আর বালু, আসাদউদ্দিন ওয়েইসিরা৷ বিজেপির দুই সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া এগিয়ে এসে তাঁদের সাহায্য করেন।
বাইরে বেরোতেই টিডিপির রামমোহন নাইডু বলেন, ‘এটা সংসদ নাকি ফাইভ স্টার হোটেলে এলাম!’ বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ মালা রায়ের মতে, ‘খেয়াল করেছেন, কোথাও একটু সূর্যের আলো ঢোকে না। পুরনো সংসদ অনেক খোলামেলা ছিল, এখানে তো হাওয়া-বাতাসও খেলছে না ঠিক মতো।’ কংগ্রেস কে সুরেশের দাবি, ‘পুরনো সংসদের মতো বিন্দুমাত্র ঐতিহ্য বা আন্তরিকতার ছাপ নেই এখানে। এত টাকা খরচা করে ফাইভ স্টার হোটেল বানালেন মোদিজি!’
নতুন সংসদ ভবন নিয়ে বিরোধীরা সীমিত পরিসরে দীর্ঘশ্বাসের ঝড় তুললেও শাসক দলীয় সাংসদরা ছিলেন খুশিতে ডগমগ৷ রাজ্য বিজেপি সভাপতি ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত বাঙালিবাবুর বেশধারী সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘ঐতিহাসিক একটা দিনের সাক্ষী হলাম। প্রত্যেক ভারতবাসী আজ গর্বিত।’ বিজেপি সাংসদ সঞ্জয় জয়েসয়ল বলেন, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। ইতিহাসের পাতায় জেনেছি পুরনো সংসদ ভবনের নির্মাণ কাহিনী। আজ জলজ্যান্ত সংসদ গড়ে ওঠার সাক্ষী রইলাম।’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগদম্বিকা পালের মতে, ‘আলোর সমুদ্রে ভেসে নতুন সংসদ ইতিহাস রচনা করবে। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’
এসবের ঊর্ধ্বে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা বর্ষীয়ান সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিব্যক্তি, ‘এই ঝাঁ চকচকে, আলোকিত বিলাসবহুল সংসদ ভবন দেখে একটা কথাই মনে হচ্ছে। আমার রাজ্যের হাজার হাজার মানুষ এখনও তাদের প্রাপ্য বকেয়া পাননি। সংসদের আলোর রোশনাই কী আলোকিত করবে তাদের জীবন? পেটের ক্ষুধা ভুলিয়ে দেবে কী?’