জলপাইগুড়ি: একসময় তাঁদের বলা হত ‘ডাকাত’, যদিও ডাকাতি বা রাহাজানির সঙ্গে দূরদুরান্তেরও সম্পর্ক ছিল না এদের। এরা ছিলেন ডাকহরকরা (Postmen)। চালু কথায় ‘রানার’ বলে ডাকা হত এদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে ‘রানার’ পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমাজে মনে করা হত ‘অচ্ছুত’। কর্মক্ষেত্রে বের হবার সময়ে তাঁদের হাতে থাকত বল্লম। আর সেটা দেখেই তাদেরকে প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই বলতেন ‘ডাকাত’। তাঁদের কোনও সামাজিক মর্যাদা ছিল না।
পরবর্তীতে ইংরেজ সাহেবরা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই রানারদের অবিভক্ত বাংলার বিক্রমপুরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই রামাস্বামী মূর্তি নামে এক রানারকে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন সাহেবরা। তারপর থেকেই রামাস্বামীরা সামাজিক মর্যাদা পান। তাঁদের উপাধি হয় ‘সামাজিক’। এই ‘সামাজিক’ উপাধি অর্জনকারী পরিবারের বংশধর হিসাবে জলপাইগুড়িতে রয়েছেন সেচ দপ্তরের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার মিতুল সামাজিক। মিতুলের কাছ থেকেই জানা গেল তাঁদের ‘সামাজিক’ উপাধি প্রাপ্তির কথা।
মিতুলের দাদু যোগেন সামাজিক জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri) ডাকঘরে (Post Office) কাজ করতেন। বাবা নগেন সামাজিক ছিলেন টেলিফোন দপ্তরের কেরানি। অন্ধ্রপ্রদেশ সীমান্তে ওদের পূর্বপুরুষরা ডাকহরকরা ‘রানার’ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সমাজবদ্ধ হওয়ার জন্য তাঁদের পূর্বপুরুষ রামাস্বামী মূর্তি, ভাগু মূর্তিদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি হেঁটে গিয়ে তাঁরা চিঠিপত্র দিতেন। পিঠে থাকত চিঠির থলে ও হাতে ধারালো অস্ত্র। পথমধ্যে কোনও বন্য জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হলে যাতে প্রতিরোধ করা যায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এই কারণে তাঁদের বংশধরদের অনর্থক ‘ডাকাত’ বলে ডাকা হত।
তবে সময় যত এগিয়েছে, মানুষের চিন্তাভাবনার ধরণেও এসেছে বদল। এখন তাঁরা আর ‘অচ্ছুত’ নন। বরং সমাজেরই অঙ্গ। মিতুল পড়াশোনা করেছেন বাংলা মাধ্যমে (Bengali Medium)। ভাবের আদান প্রদান সবকিছুই বাংলা ভাষাতেই করেন। তিনি মনে প্রাণে বাঙালি। সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্ত রকম অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। তিনি বলেন, ‘পূর্ব পুরুষরা সমাজের ছাতার তলে আসবার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তাদের কষ্টের ফসল আমরা এখন ভোগ করছি। সমাজ আমাদেরকে সমাদরে গ্রহণ করেছে এটাই বড় প্রাপ্তি।’ বর্তমানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে তিনটি ‘সামাজিক’ উপাধিধারী পরিবার রয়েছে। তিনটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২১ জন। একটি পরিবার রয়েছে জলপাইগুড়ি পাণ্ডাপাড়াতে। অপর দুটি কলকাতায়।