শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি : এবার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখলে নাম জড়াল খোদ পুলিশের। খোদ শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের নাম জমি দখলকারীদের তালিকায় ওঠায় চরম অস্বস্তিতে দার্জিলিং জেলা প্রশাসনও। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা তথা দার্জিলিংয়ের প্রাক্তন সাংসদ প্রয়াত রতনলাল ব্রাহ্মণের ছেলে তেজেন্দ্রলাল ব্রাহ্মণ এবং কৃষ্ণা কর্মকার নামে চম্পাসারির এক মহিলার রায়তি জমি দখল করে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারের দপ্তরের একাংশ এবং প্যারেড গ্রাউন্ড তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ। সব মিলিয়ে দুজনের প্রায় এক একর জমি দখল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীদের আইনজীবী। হাইকোর্টের নির্দেশের পর দশ বছর কেটে গেলেও দখল করা জমি খালি করে দেওয়া বা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ কোনওটিই করেনি রাজ্য সরকার। তাই সোমবার শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনার ও রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজিকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন তেজেন্দ্রলাল ও কৃষ্ণার আইনজীবী সন্দীপ মণ্ডল। ১৫ দিনের মধ্যে পদক্ষেপ না করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি।
পুলিশের কর্তারা অবশ্য খোলসা করে কিছু বলতে চাইছেন না। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার অখিলেশ চতুর্বেদীর বক্তব্য, ‘বিষয়টি সেভাবে জানা নেই। সব কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে। তারপরই যা বলার বলব।’ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (হেড কোয়ার্টার) জয় টুডুর কথা, ‘নোটিশ হাতে পেলে সেইমতো উত্তর দিয়ে দেওয়া হবে।’ যদিও পুলিশ সূত্রের খবর, আইনি নোটিশে জমি ইস্যুতে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন পুলিশকর্তারা। ওই ইস্যুতে অভিযোগকারীরা ফের হাইকোর্টে গেলে বিচারপতিদের কড়া ভর্ত্সনার মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। তাই কীভাবে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা যায় তা নিয়ে উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সোমবার বিকেল থেকেই দফায় দফায় আলোচনা করেছেন।
এ যেন যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানোর কথা সেই সর্ষের মধ্যেই ভূতের বাসা। পুলিশের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। সন্দীপ জানিয়েছেন, পাঁচটি প্লটে তেজেন্দ্রলাল ও কৃষ্ণার মোট ৯৮ ডেসিমাল জমি দখল করে কমিশনারেটের অফিস ও প্যারেড গ্রাউন্ড তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জমিতে প্রাচীর দেওয়ার সময়ই বাধা দেওয়া হয়েছিল। তা পাত্তা দেয়নি পুলিশ। ২০১৩ সালে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন তেজেন্দ্রলাল ও কৃষ্ণা। সেই মামলায় মাটিগাড়া ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিককে জমির মাপজোখ করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। ১-৪-২০১৬ তারিখে রিপোর্ট দিয়ে মাটিগাড়ার বিএলএলআরও জানিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট জমিগুলি অভিযোগকারীদের নামেই নথিভুক্ত রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে পুলিশের তরফে জমি কিনে নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল বলে জানান সন্দীপ। সেই প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন তেজেন্দ্রলাল ও কৃষ্ণা। তবে বছর ঘুরলেও কমিশনারেটের তরফে কোনও তত্পরতা না দেখানোয় ২০১৭ সালে ফের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন দুই অভিযোগকারী। ১১-০৯-২০১৮ তারিখে সেই মামলার রায় হয়। রাজ্য তাদের জমি অধিগ্রহণ করতে ইচ্ছুক কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চার সপ্তাহের মধ্যেই মামলাকারীদের জানিয়ে দিতে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের প্রধান সচিবকে। তবে পাঁচ বছর কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত কমিশনারেটের তরফে তেজেন্দ্রলাল বা কৃষ্ণাকে কিছুই জানানো হয়নি বলেই জানিয়েছেন সন্দীপ। অসুস্থ থাকায় কথা বলতে পারেননি তেজেন্দ্রলাল। তিনি জানান, তাঁর হয়ে যা বলার তা তাঁর আইনজীবীরাই বলবেন।
কমিশনারেটের বিরুদ্ধে যে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে ওই এলাকায় সেই জমির দাম কয়েক কোটি টাকা। অভিযোগকারীদের হয়ে হাইকোর্টে মামলা লড়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী অনুপ মিত্র। তাঁর বক্তব্য, ‘মাফিয়ারা জমি দখল করে। কিন্তু এখানে পুলিশই দখল করে বসে আছে। বারবার চিঠি দিলেও কোনও পদক্ষেপ করেনি। এরফলে সার্বিকভাবে পুলিশের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। আদালতে দাঁড়িয়ে পুলিশের আইনজীবীরা স্বীকার করে নিয়েছেন, জমি তাদের নয়। তারপরও দখলমুক্ত করা হয়নি জমি। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিনেও নেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের ভূমিকাই যদি এরকম হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে?’
সন্দীপের কথা, ‘তেজেন্দ্রলাল উত্তরবঙ্গের নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। বাবার পরিচয়কে কাজে লাগিয়েও তিনি কিছু করেননি। ১০ বছর ধরে মুখ বুজে সব সহ্য করেছেন। পুলিশ তেজেন্দ্রলাল ও কৃষ্ণাদেবীর সরলতার সুযোগ নিচ্ছে। নাগরিকদের কষ্টার্জিত টাকায় কেনা জমি যাতে দখল হয়ে না যায় তা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। সেই রক্ষকই এখন কাঠগড়ায়। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে দ্রুত পদক্ষেপ না করলে যা যা আইনি পদক্ষেপ করার সব করা হবে।’