রণজিৎ ঘোষ, পানিঘাটা: ‘বন্ধ চা বাগানে দু’বেলা খাবার জোটানোই দায় হয়ে পড়েছে। ফাওলইয়ের সুবিধা কয়েক মাস পাওয়ার পর আচমকাই সেই তালিকা থেকে নাম বাদ গিয়েছে। ঘরে অসুস্থ স্বামী, চিকিৎসা করানোর মতো টাকা হাতে নেই। এভাবে কতদিন বেঁচে থাকা যায়?’ দাওয়ায় ধোঁয়া ওঠা ভাঙা উনুনে ছাইমাখা হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন কৃষ্টা টিগ্গা। বয়স খুব বেশি হলে ৪২ পেরিয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হবে বয়সের ভারে নতজানু। পানিঘাটা চা বাগানের অবস্থাটাও এখন ঠিক কৃষ্টার মতোই।
বন্ধ চা বাগান এখন কয়েকজন রাজনৈতিক ‘দাদা’র দখলে। এই ‘দাদা’রাই কাঁচা চা পাতা তুলে বাজারে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। শ্রমিক মহল্লায় কান পাতলে এমন কথাই ভেসে আসে।
কিছু শ্রমিককে দিন প্রতি ২৫০ টাকা হাজিরায় রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে শ্রমিকদের সমস্যা মিটছে না। বাধ্য হয়ে কেউ দেশে, কেউ বিদেশে কাজের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু সব পরিবারে তো আর বাইরে কাজ করার মতো ছেলে বা মেয়ে নেই। সেই পরিবারগুলি না খেয়ে কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। অনটনের সংসারে অপুষ্টির জেরে রোগভোগও চেপে বসেছে। অনেকেই চোখ এবং কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। এখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ভোটের আগে নেতা-নেত্রীরা এসে প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরেছেন। কিন্তু বাগান খোলেনি। তাই এবার আর ভোট নিয়ে মাতামাতি নেই শ্রমিক মহল্লায়। ভোট নিয়ে আর নেতাদের কথায় বিশ্বাস করবেন না এমনটাই বলছিলেন বিনোদ ঘাটানি, গোপাল ছেত্রী, সংমিত তামাংয়ের মতো শ্রমিকরা।
ভোট এসে গিয়েছে। গ্রামগঞ্জে তেরঙা ও গেরুয়া পতাকার ছড়াছড়ি। আছে লালও। কিন্তু পানিঘাটা যেন অন্য জগৎ। এত প্রতিশ্রুতি দিলেও বাগান না খুলতে পারায় নেতারাও আর এ মুখো হন না। ‘যেখানে ভাত জোটানোই দায়, সেখানে ভোট তো বিলাসিতা’, বললেন গোপাল। এক সময়ের দাপুটে শ্রমিক নেতা মেসা সৌরিয়ার গলাতেও এখন হতাশা ঝরে পড়ে, ‘বাগানটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারলাম না।’
২০১৫ সাল থেকে বন্ধ পানিঘাটা চা বাগান। সেই সময় বাগানে স্থায়ী শ্রমিক এবং অফিসকর্মী মিলিয়ে সংখ্যা ছিল ৮৫৫। ৭৫০ জন অস্থায়ী শ্রমিক ছিলেন। শ্রমিকদের প্রফিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) এবং গ্র্যাচুইটি নিয়ে বাগানে সমস্যা চলছিল। এরই মাঝে পুজোর বোনাসের দাবি উঠতেই কর্তৃপক্ষ রাতের অন্ধকারে বাগান ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর ফেরেনি। প্রায় ৭৫০ একরের পানিঘাটা চা বাগান সেই সময় থেকেই বন্ধ হয়ে রয়েছে। এই বাগান পুনরায় চালু করা, প্রয়োজনে মালিকানা বদলের দাবি নিয়ে দলের নেতা-মন্ত্রীদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন পানিঘাটার তৎকালীন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা রাজেন মুখিয়া। কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থে বাগান পুনরায় চালুর ব্যবস্থা হয়নি। পরবর্তীতে রাজ্য সরকার বাগানে ফাওলই চালু করে। এর মাধ্যমে স্থায়ী শ্রমিকরা মাসে ১৫০০ টাকা করে ভাতা পান। সেখানেও প্রচুর অভিযোগ। এদিন বাগান শ্রমিকরা বলছেন, ‘মাত্র ৪০০ জন ফাওলই পাচ্ছেন। বাকি আরও ২৫০-২৬০ জন অনেক আবেদন করেও এই সুযোগ পাচ্ছেন না। কারও আবার তিন মাস পর একবার ১৫০০ টাকা করে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকছে।’
বাগানের বিচ লাইন, গৈরি লাইন, ডারা লাইন, ফ্যাক্টরি লাইন, গিরমিট লাইন সহ অন্যান্য শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে দেখা গিয়েছে প্রায় প্রতি বাড়িতেই অসুস্থ বয়স্ক রয়েছেন। তাঁদের প্রায় সকলেই বাগানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। কিন্তু কেউই অবসরকালীন আর্থিক সুবিধাগুলি এখনও পাননি। শ্রমিক মহল্লায় পরিস্রুত পানীয় জল, পথবাতি কিছুই নেই। একদা সদা ব্যস্ত চা কারখানাতেও মরচে ধরেছে। প্রচুর যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গিয়েছে, এখনও ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে চা কারখানা, বাবুদের দামি গাড়ি।
বিনোদ বলছিলেন, ‘২০১৪-১৫ সালে অবসর নিয়েছি। কিন্তু এখনও পিএফ, গ্র্যাচুইটি কিছুই পাইনি। কেউ পাথর ভেঙে, কেউ নদীতে বালি তোলার কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। সেখানেও নিয়মিত কাজ পাচ্ছি না। ফলে দু’বেলা খাবার জুটছে না।’
বাগান বন্ধ থাকায় কার্সিয়াংয়ের ছোট্ট টিলার মতো পানিঘাটার অর্থনীতিও বড় ধাক্কা খেয়েছে, এমনটাই দাবি ব্যবসায়ীদের।