- দ্যুতি মুখোপাধ্যায়
সামরিক উর্দিধারী চড় মারছেন নিরস্ত্র অসামরিক নাগরিকের গালে।
শুধু এই বাক্যটুকুতে বিবৃত ঘটনার ঠিক-ভুল-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই, কোনও গণতান্ত্রিক দেশেই থাকতে পারে না। এই ঘটনায় আপাতভাবে উর্দিধারীর ক্ষমতা বেশি এবং তিনি আঘাত হানছেন আপাতভাবে কম ক্ষমতার অধিকারী উর্দিবিহীন নাগরিকের উপর – ফলে আপাতভাবে এক্ষেত্রে উর্দিধারী দোষী।
মান্ডির নবনির্বাচিত বিজেপি সাংসদ, তারকা অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতকে চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে সিআইএসএফ জওয়ান কুলবিন্দর কউর চড় মেরেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তার নিন্দা করছেন রাজনীতিক থেকে সুশীল নাগরিকগণ, এমনকি কঙ্গনার রাজনীতি যাঁরা পছন্দ করেন না তাঁরাও। বলছেন, এটা শোধবোধের রাজনীতি। বলছেন, এবার যদি কঙ্গনার দলের লোকে বিরোধী কাউকে চড় মারে তার সমালোচনার কোনও অধিকার থাকবে না।
যেটা স্বাভাবিক নয় সেটা হল, কুলবিন্দরের দিকে উপচে পড়া সমর্থনের ঢেউ, শুধু তথাকথিত রাজনীতি-সচেতন মহলে নয়, আপামর জনগণের মধ্যেও।
এটা কেমন হল? ঠিক-ভুল-নৈতিকতার বিচার কি সবাই মিলে ভুলে গেল?
ওই যে শুরুর বাক্যটা, ওটা আসলে একটা দরজা। দরজার পিছনে আছে ইতিহাস, ঘটনাপ্রসঙ্গ, রাজনীতি এবং সম্ভবত রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করা একধরনের সর্বজনীন নৈতিকতার বোধ।
দরজা খুললে প্রথমেই কানে আসবে একটা রাগত স্বর : ‘কৃষক আন্দোলনের সময় ও বলেছিল চাষিরা নাকি ১০০ টাকার জন্য ওখানে গিয়ে বসেছেন। ও বসেছিল নাকি ওখানে? আমার মা ওখানে বসে ছিলেন যখন ও বয়ান দিচ্ছিল!’
ক্ষমতার সমীকরণটা একটু বদলে গেল না? কৃষক-কন্যা চড় মারছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা প্রবল জনপ্রিয় এক তারকাকে, যিনি অন্যায্য কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের ‘১০০ টাকায় কেনা’ বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন এককালে। ওই টুইটে এই আন্দোলনকারীরা পাকিস্তান-সমর্থিত বলেও ইঙ্গিত করেন তিনি।
কঙ্গনা অবশ্য এটুকুতেই থেমে থাকেননি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সেই কুখ্যাত ‘১০০ টাকায় কেনা’ টুইটটি ‘উসকানিমূলক’ বলে চিহ্নিত হওয়ার পর তা ডিলিট করতে বাধ্য হন কঙ্গনা। কিন্তু কিছুদিন পরেই ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে আবারও কৃষকদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলেন তিনি, দাবি করেন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য হল ভারতের মাটিতে অস্থিরতা ও বিভাজন তৈরি করা, যার সুযোগে নাকি চিন ভারত দখল করে নেবে! ২০২১-এরই মে মাসে টুইটার থেকে বহিষ্কৃত হন কঙ্গনা; টুইট করে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে ভোট-পরবর্তী হিংসার জবাবে মোদি যেন তাঁর ‘বিরাট রূপ’ প্রদর্শন করেন – যে রূপ তিনি প্রদর্শন করেছিলেন ২০০২ সালের গুজরাটে। আশা করি পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে না ২০০২ সালের গুজরাটে ঠিক কী ঘটেছিল। আশা করি এও মনে করিয়ে দিতে হবে না যে মোদি নিজে বরাবর সেই দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করেছেন এবং বারবার আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছেন।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বা বিরুদ্ধ মত পোষণকারীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করা স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী শক্তিদের পুরোনো কৌশল। বিরুদ্ধমত দমন করতে শাসনযন্ত্র যদি হিংসার পথ নেয় – যা এই সরকারের ক্ষেত্রে বারবার দেখা গিয়েছে – তবে তাকে একটা গ্রহণযোগ্যতার মোড়ক দেওয়া যায় সন্ত্রাসদমন করছি বলে। এই কাজটা আগে নেতা-মন্ত্রীরা করতেন, আন্তর্জাল তথা সামাজিক মাধ্যম পরবর্তী যুগে তাঁদের পাশাপাশি উঠে আসছেন সক্রিয় রাজনীতিতে সরাসরি সংযুক্ত না থাকা ব্যক্তিরাও, যাঁদেরকে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ বলা হয়ে থাকে। গায়ে রাজনৈতিক দলের তকমা না থাকার কারণে এঁদের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তুলনায় বেশি থাকে জনগণের কাছে, ফলে প্রভাবটাও পড়ে বেশি।
২০২০-’২১ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকা কঙ্গনার উসকানিমূলক টুইট-মন্তব্যে যে আন্দোলনকারীদের উপর প্রত্যক্ষ হিংসায় মদত পড়েছিল এবং কৃষকরা আদতে খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী- এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তাতে এখন সন্দেহের অবকাশ নেই। আন্দোলন চলাকালীন বারবার হিংসা নেমে এসেছে কৃষকদের উপর, সেই হিংসা শুধুমাত্র আইনরক্ষকরা নামিয়ে আনেননি। আন্দোলনে নিহত কৃষকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সেইসব অপুলিশি হিংসায় কঙ্গনার উসকানির প্রত্যক্ষ মদত ছিল। বলতে পারেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। ঘৃণাবচন কিন্তু নয়। তা ফৌজদারি অপরাধ এবং এখনও পর্যন্ত সেই অপরাধের শাস্তি কঙ্গনা পাননি, উলটে পেয়েছেন শাসকদলের নির্বাচনি টিকিট এবং নির্বাচনের পর সাংসদের পদ।
প্রাণঘাতী হিংসায় প্রত্যক্ষ উসকানির বিপ্রতীপে একটি চড়। হত্যার জবাবে অপমান। নৈতিকতার পাল্লাটা একটু একটু নড়ছে কি?
এইইই হুউউশ! চ্যানেলটা বদলে গেল। আমরা চলে এসেছি বছরখানেক আগে। ৩১ জুলাই, ২০২৩, ভোররাত। জয়পুর-মুম্বই সেন্ট্রাল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে আচমকা শুরু হয় হত্যালীলা। এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেন আরপিএফ জওয়ান চেতন কুমার। নিহতদের মধ্যে একজন তাঁর সহকর্মী। বাকি তিনজন সাধারণ যাত্রী। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বলছে, হত্যার আগে এই তিনজনেরই নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন চেতন কুমার। তাঁদের নাম? আবদুল ভানপুওয়ালা, সৈয়দ সইফুদ্দিন এবং আসগর আব্বাস শেখ।
ঘটনার অব্যবহিত পরে কোনও এক যাত্রীর তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কামরার মেঝেয় পড়ে আছে রক্তাক্ত মৃতদেহ আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রাইফেলধারী জওয়ান বলছেন, ‘অগর ভোট দেনা হ্যায়, হিন্দুস্তান মে রেহনা হ্যায়, তো মোদি অউর যোগী ইয়েহি দোনো হ্যায়।’ উর্দিধারীর হিংসার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম, যে দুটো নামের সঙ্গে মুসলিমবিরোধী হিংসার ইতিহাস অঙ্গািঙ্গ জড়িত। উর্দি এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার বয়ান প্রচারে, তার মাধ্যম– হত্যা।
এই আবার পিছলে গেল রিমোট! সরসরিয়ে আমরা চলে এসেছি ২০১৭ সালের হিংসাবিধ্বস্ত কাশ্মীর উপত্যকায়। শ্রীনগরে উপনির্বাচন সেদিন। বহুদিন ধরে বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা। পথচারীরা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, এগিয়ে আসছে সামরিক কনভয়, আর একদম সামনের জলপাই সবুজ জিপের বনেটে দড়ি দিয়ে বাঁধা রক্তাক্ত তরুণ এক। শ্রীনগর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের চিল ব্রাস গ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ দার। বুকে সাঁটা কাগজে তাঁকে ‘পাথর ছোড়া সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করে হুঁশিয়ার করা হয়েছে, কনভয়ে কেউ পাথর ছুড়লে তার এই দশাই হবে।
প্রায় হপ্তাখানেক পর ইন্টারনেট ফিরলে ভাইরাল হয়ে যায় জিপে বাঁধা ‘মানব ঢাল’ ফারুকের ছবি আর ভিডিও। রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর যে জওয়ান ফারুককে জিপে বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই লিতুল গগৈ পরে দাবি করেন যে ফারুক গাড়ির দিকে পাথর ছোড়া একটি দলের মধ্যে ছিলেন। ফারুকের পরিবার কিন্তু জানায় যে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে জোর করে গাড়িতে বাঁধা হয় তাঁকে। একাধিক কাশ্মীর বিশেষজ্ঞও গগৈয়ের বয়ানে সন্দেহ প্রকাশ করেন – তাঁদের মতে, পাথর ছুড়তে থাকা জনতার ভিতর থেকে একজনকে ওভাবে টেনে বার করে নিয়ে আসা আদৌ সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রক্ষমতার ক্রীড়নক উর্দিধারী, শাসকদলের বয়ান প্রচারক উর্দিধারীরা হত্যা করেন, রক্তাক্ত করেন। শাসকদলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা চাষিদের প্রতি সহমর্মী উর্দিধারী একটি চড় মেরেছেন। লিঙ্গরাজনীতির একটি প্রচলিত বয়ান আছে: ছেলেদের সবচেয়ে বড় ভয় হল মেয়েরা তাদের অপমান করবে। মেয়েদের সবচেয়ে বড় ভয় ছেলেরা তাদের মেরে ফেলবে। এই আপ্তবাক্যটাকে একটু বদলে নিয়ে যদি বলি: শাসকের সবচেয়ে বড় ভয় শাসিত তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠাবে, অপমান করবে। শাসিতের সবচেয়ে বড় ভয়, শাসক তাকে মেরে ফেলবে। নৈতিকতার পাল্লাটা কীরকম একটা ঘেঁটে গেল, তাই না?
উর্দির আড়াল থেকে শাসনক্ষমতার আস্ফালন অনেক দেখেছি আমরা। এবার না হয় উর্দির সীমানা পেরিয়ে জনগণের প্রতিবাদটাকেও চিনে নিতে শিখি।
(লেখক অনুবাদকর্মী ও গ্রন্থকার)