উত্তর সম্পাদকীয়

ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বুদ্ধপূর্ণিমা

 

  • দেবাশীষ সরকার

‘যিনি আলোক প্রাপ্ত, আমি সেই বুদ্ধের শরণ প্রার্থনা করি।’

একটা বিরাট সাদা হাতি নেমে আসছে আকাশ থেকে। মাঝআকাশে জ্বলজ্বল করছে ভরা পূর্ণিমার গোল চাঁদ। বর্ষা আসতে এখনও প্রায় দু’মাস বাকি। আকাশে চাঁদের আশপাশে হালকা, ঘন, নানা স্তরে অল্প অল্প মেঘ। তাদের ফাঁক দিয়ে নেমে আসা চাঁদের আলোয় ভাসছে মাঠঘাট। আর তারই মাঝে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সেই সাদা ঐরাবত।

স্বপ্ন দেখছেন এক মা। যিনি পৃথিবীতে নিয়ে আসছেন এক নতুন প্রাণ। যিনি মানুষের সভ্যতা, ইতিহাস, সমাজচিন্তা, সবকিছুকে এক যুগসন্ধিতে বসাতে চলেছেন তাঁর এই আনন্দ ভরা প্রসব যন্ত্রণা দিয়ে। এই মায়ের নাম মায়া দেবী আর তাঁর সদ্যোজাত সন্তান হবেন গৌতম বুদ্ধ। আমাদের বুদ্ধদেব।

প্রায় ২৫০০ বছর আগে, ঠিক আজকের এই রাতেই মা মায়া দেবী জন্ম দিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধর।

এই রকমই তো আমরা জেনে এসেছি ছোটবেলা থেকে। ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন এই কাহিনী কতটা সত্যি আর কতটা মানুষের শ্রদ্ধা মেশানো মনের মাধুরী। তবে  পুরাণ, কাব্য ঘেঁটে  ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ কেন্দ্রিক এই  ঐশ্বরিক উপাখ্যান বা ‘মিথ’-এর সত্যতা বা অসত্যতা বের করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

এই বুদ্ধপূর্ণিমার মতো যে কোনও প্রাচীন রীতিনীতি বা ‘মিথ’ কখনও হাওয়া থেকে জন্মায় না।  নানা সময়ে কোনও প্রাকৃতিক কারণে উদ্ভূত সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে অনেক নিয়মনীতি প্রচলিত হয়। কালক্রমে সেগুলোর ভেতরের যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ ভুলে যায়। তাই উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বিধেয়গুলো ভাঙতে ভাঙতে যেমন-তেমন করে বদলাতে থাকে আর বেঁচে থাকে আপাত অর্থহীন ‘মিথ’  বা ‘বিশ্বাস’ হিসাবে।

যাঁরা অত্যুৎসাহী ধর্মপ্রাণ, তাঁরা এই ‘মিথ’-কেই সর্বসত্যি বলে নিজেরা খুশি হন। আর যাঁরা তথাকথিত প্রগতিশীল তাঁদের প্রথম কাজ হয় এই ‘মিথকে’ দুর ছাই করা। এই দুয়ের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সত্যিকারের যৌক্তিক ইতিহাস আর বিজ্ঞান বের করে আনা যায়।

এদিনে ‘সাদা হাতি আকাশ থেকে নেমে আসাটা’ সেকালের কোনও চিন্তকের চিন্তার বা কোনও ঘটনার রূপক হতে পারে। কবির কল্পনার ফসল হতে পারে। কথাকারের কথা কাহিনী হতে পারে। তবে ‘এই দিনটা’ তো চরম বাস্তব। এই আমার, আপনা‌র জীবনের চড়াই উতরাইয়ের মতো, সামনে রাখা খবরের কাগজ, কম্পিউটার বা মুঠোফোনের মতোই বাস্তব।

তাহলে ‘এই দিনটা’ বলতে ‘কোন দিনটা’ বোঝানো হয়?

সারা বছরে প্রতিটা দিনের মতো প্রতিটা পূর্ণিমারও একটা নিজস্ব ঠিকুজি কুলজি আছে। আকাশের বুকে প্রতিদিন চাঁদ, সূর্য, তারা সবাই পূর্ব থেকে পশ্চিমে দৌড়াতে থাকে। দিনগত চলনের এই দৌড়টাকে যদি ভুলে যেতে পারি, তবে দেখব যে তারাগুলো নড়ছে না। নিজের নিজের জায়গাতে এক্কেবারে স্থির। কালো আকাশের ক্যানভাসের ওপরে বসানো ছোট্ট  ছোট্ট হিরের টুকরো যেন। আর তাদের ওপর দিয়ে সূর্য প্রতিদিন একটু একটু করে পশ্চিম থেকে পূর্বে এগিয়ে চলেছে। আজ যে তারার ওপরে সূর্য বসে আছে, কাল তার থেকে একটু পূর্বে থাকবে। এই করে আবার ৩৬৫ দিন পরে সেই এক তারার ওপরে এসে পৌঁছাবে। পার হবে এক বছর।

চাঁদ ও এইভাবে চলছে। তবে অনেক দ্রুত। এই ৩৬৫ দিনে চাঁদ ১২ বার গোটা আকাশকে বেশ কিছু  নির্দিষ্ট  উজ্জ্বল তারার  আশপাশ দিয়ে পাক খেয়ে ফেলবে। তাই ১২টা পূর্ণিমা হবে।  প্রতিটা পূর্ণিমাতে, পৃথিবীর যে দিকের আকাশে চাঁদ থাকে, সূর্য থাকবে আকাশে ঠিক তার উলটো দিকের আকাশে। সেই উলটো দিকের তারাদের কাছে। তাই মাঝরাতে পূর্ণিমার চাঁদ মাঝআকাশে দেখা যায়।

সূর্য বছরের কোন সময়ে কোন তারাদের কাছে থাকবে তা দিয়ে আমরা সেই সময়ে কোন ঋতু তা বুঝতে পারি আর আগামী ঋতুর ভবিষ্যদ্বাণী পাই। কিন্তু সূর্যের খুব জোরালো আলোর জন্য তার আশপাশের তারাগুলোকে দেখতেই পাওয়া দুষ্কর। এই ঝামেলা এড়ানোর একটা সহজ বুদ্ধি আছে।

আকাশের বুকে চেনা তারাগুলো সবাই কে কোথায় থাকে তা তো জানা। আর চাঁদ  পূর্ণিমাতে সূর্যের ঠিক উলটো দিকে থাকে। তাহলে প্রতি পূর্ণিমাতে আকাশে চাঁদের খুব কাছে যে তারা আছে তাকে দেখে আকাশে ঠিক উলটো দিকে কোন তারা আছে তা সহজেই বুঝতে পারি। তাহলে সেই তারার পাশেই তখন সূর্য আছে। আর এ থেকেই ঋতুর আগাম খবর জানতে পারি।

বোঝা গেল প্রতি পূর্ণিমাতে চাঁদের অবস্থান এক-একটা ঋতুর আসার আগাম খবর দেয়।  তাই সারা পৃথিবীতে,  ইতিহাসেরও আগে থেকে, প্রতিটা প্রাচীন জনজাতির কাছে প্রতিটা পূর্ণিমা নানা সময়ে নানা নামে চেনা হয়ে এসেছে। সেই রীতি মেনেই, যে পূর্ণিমাতে চাঁদ ‘জ্যেষ্ঠা’ নামের তারার  কাছে  থাকে সেই পূর্ণিমা হল আমাদের কাছে ‘এই দিনটা’। জ্যেষ্ঠার কাছে থাকাটাই হল এই পূর্ণিমার ঠিকুজি কুলজি। আর এই পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠার সখ্যর জন্যই বছরের এই সময়টা ‘জ্যৈষ্ঠ মাস।’ এর আগের পূর্ণিমাতে চাঁদ ছিল  ‘বিশাখা’ নক্ষত্রে। তাই সেই সময় ছিল বৈশাখ মাস। তার  আগের পূর্ণিমাতে চাঁদ জড়িয়েছিল  ‘চিত্রার’ সঙ্গে। তাই সেটা ছিল চৈত্র মাস।

জ্যোতির্বিদরা আগাগোড়াই সব পূর্ণিমাকে বা অমাবস্যাকে তাদের ঠিকুজি কুলজি দিয়েই চিনে এসেছেন। কিন্তু সাধারণের বোঝার সুবিধার জন্য সেইসব অমাবস্যাকে বা পূর্ণিমাকে একটা করে নাম দেওয়া হয়েছে। আর এই নামকরণ করা হয়েছে কোনও বিশেষ ঘটনা বা বিশেষ অবস্থাকে মাথায় রেখে। একইভাবে এই জ্যেষ্ঠা পূর্ণিমার নাম হয়েছে ‘বুদ্ধপূর্ণিমা।’

তবে বিরাট এক মজা অপেক্ষা করে আছে। শুরুতে বলেছি, বুদ্ধপূর্ণিমার থেকে… ‘বর্ষা আসতে এখনও প্রায় দু’মাস বাকি।’ কিন্তু এখন তো জ্যৈষ্ঠ মাস। এর পরেই আষাঢ়। মানে এক মাস পরেই বর্ষা। তা হলে ব্যাপারটা কি এই রকম যে দুই-আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধপূর্ণিমার দু’মাস পরে পূর্ণিমা হত আর এখন এক মাস পরে হয়? প্রাকৃতিক বিষয়টা কি এতটাই আষাঢ়ে হতে পারে?

বিরাট মজাটা এইখানে। প্রাকৃতিক নিয়মে আমাদের গোটা ঋতুচক্রটা আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রতি ৭২ বছরে ১ দিন করে। আর  ২৬,০০০ বছরে পুরো এক পাক খেয়ে আবার ফিরে আসবে আগের জায়গাতে। আজ ক্যালেন্ডারের পাতায় যে দিন বা যে মাসে আমি  যে ঋতু পাচ্ছি, ১০০০ বছর পরে সেই ঋতু ১৫ দিন আগে হবে। মানে ঋতুগুলো ক্যালেন্ডারের দিন, তারিখের কাছে চলে আসছে ক্রমাগত। আজ থেকে ২০০০ বছর আগে, যখন গৌতম বুদ্ধকে সারা পৃথিবী চিনে গিয়েছে। তাঁকে মনে করে রাখার চেষ্টা করছে, তখন থেকেই হয়তো জ্যেষ্ঠা পূর্ণিমার নাম হয়েছে ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’। বা হয়তো সত্যি এই দিনেই উনি জন্মেছিলেন। এটা নিতান্তই রূপক নয়। তাই তখন ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ থেকে বর্ষা দু’মাস দূরে ছিল। ২০০০ বছর পেরিয়ে এসে এই সময়ের দূরত্বটা কমে ১ মাস হয়ে গেছে। আরও দু’হাজার বছর পরে বুদ্ধপূর্ণিমা পৌঁছে যাবে বর্ষার ঠিক শুরুতে।

পৃথিবীর আরও অনেক প্রাচীন দেশের মতো সিন্ধু নদের অববাহিকায় আমাদের পূর্বপুরুষরাও বুদ্ধের জন্মের ৫০০০ বছরেরও বেশি আগে থেকে চাঁদ, তারাদের চলাচলের হিসাব করতে শিখে গিয়েছিলেন।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

অনেক কিছুই গোপনীয়তার মোড়কে

  সানি সরকার কোথাও রাস্তা ওপর দিয়ে জল বইছে, কোথাও আবার একের পর এক বাড়ি…

34 mins ago

পুরনিগমের সংবর্ধনায় ব্রাত্য শিলিগুড়ি শিক্ষা জেলার সেরা ছাত্রী

শিলিগুড়ি: পুরনিগমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ব্রাত্য মাধ্যমিকে শিলিগুড়ি শিক্ষা জেলায় মেয়েদের মধ্যে সেরা ছাত্রী। পুরনিগমের সংবর্ধনা…

36 mins ago

বিপদ দাঁড়িয়ে দুয়ারে

  দীপ সাহা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ছে একেকটা বাড়ি। ঝোরাগুলোও আর ঝোরা নেই। যেন…

47 mins ago

তিস্তা বিপর্যয়ের জেরে ধাক্কা সিকিমের পর্যটনশিল্পে, পর্যটকদের ভিড় দার্জিলিংমুখী

শিলিগুড়ি: তিস্তা বিপর্যয়ের জেরে বর্তমানে সিকিমে পর্যটনে সর্বনাশ হয়ে গেলেও দার্জিলিংয়ে যেন পৌষমাস। সিকিমে বেড়াতে…

51 mins ago

Cough Syrup Seized | বাংলাদেশে পাচারের ছক, হাতবদলের সময় কাফ সিরাপ সহ ধৃত ২

ফাঁসিদেওয়া: বাংলাদেশে পাচারের আগে বিপুল পরিমাণ কাফ সিরাপ সহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করল ঘোষপুকুর ফাঁড়ির…

1 hour ago

Landslide | প্রবল বৃষ্টিতে ফের ধস, বন্ধ ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে যান চলাচল

শিলিগুড়ি: প্রবল বর্ষণে ফের বিপর্যস্ত পাহাড় থেকে সমতল। বৃষ্টির জেরে নতুন করে ধস (Landslide) নামায় বন্ধ…

2 hours ago

This website uses cookies.