Sunday, May 19, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়তাঁর জন্মদিন এক অর্থে আমাদেরও

তাঁর জন্মদিন এক অর্থে আমাদেরও

 

  • পবিত্র সরকার  

ধর্মের বাইরেও উৎসবের একটি চাহিদা আছে।  গ্রামে গ্রামান্তরে নৌকাবাইচ, গোরু-মোষের দৌড়, মেলা, ফুটবল খেলার ফাইনাল ইত্যাদি প্রায় উৎসবের চেহারা নেয়।  তবে তা নেহাতই স্থানীয় উৎসব, দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীকে তা উত্তেজিত বা উদ্বেলিত করে না, নববর্ষ যেমন করে। এই উৎসব বিশেষত বাংলাদেশের এক সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, যা পশ্চিমবঙ্গে, বিচ্ছিন্ন চেষ্টা সত্ত্বেও, এখনও তেমন ব্যাপ্তি বা উজ্জ্বলতা পায়নি।

পশ্চিমবঙ্গে আর-একটি দিন এই এক ‘জাতীয়’ সাংস্কৃতিক উৎসবের আকৃতি ধারণ করতে চলেছে। সেটি পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। কয়েক বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সুবাদে এই লেখক সেই উৎসবের অন্দরমহলের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হয়ে পড়েছিল, তারই স্মৃতি থেকে কিছু সংগ্রহ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

আগে কলকাতায় এই উৎসবের প্রধান কেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি।  আমি যৌবনে ভোরবেলায় উঠে সেখানে গিয়েছি, সেখানে বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী আগে একসঙ্গে এই জন্মদিনের অনুষ্ঠান করত।  অনেকদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অনুষ্ঠান ছিল কলকাতায় প্রধান অনুষ্ঠান। পরে মধ্য কলকাতায় রবীন্দ্র সদনে একটি অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছে। নানা জায়গায় এখন ছড়িয়ে পড়ছে এই উৎসব।

রবীন্দ্রনাথের বাড়ি হল রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, কাজেই তার সঙ্গে অন্য কোনও অনুষ্ঠানের কোনও তুলনা হতে পারে না।  এখানে অনুষ্ঠান মানে শুধু গান আর আবৃত্তি বা পাঠের পরম্পরা নয়।  তার শুরু হয় ভোর সাড়ে-পাঁচটায় সানাইবাদন দিয়ে।  প্রথা এবং পদাধিকার মেনে উপাচার্য রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণকক্ষে যান, তিনিই প্রথম বিশাল এক শ্বেতপদ্মের মালা অর্পণ করেন।  ঘরের কেন্দ্রে একটি মস্ত মণ্ডলাকার আলপনার কেন্দ্রে একটি বিশাল তামার টবে বসানো থাকে রজনীগন্ধার রাশি, সেই টবটিকে ঘিরেই মালাটি নামিয়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য কর্তৃপক্ষও মালা দেয়, মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য সরকারি মালাও এসে পড়ে।  ঘরটি অচিরে শ্বেতপদ্মের মালায় ভরে ওঠে, শ্বেতপদ্ম, রজনীগন্ধা ও জুঁই এই দিনটিতে বিশেষ সমাদৃত ফুল। তার পরে উপাচার্য নেমে এসে প্রাঙ্গণে রুশ ভাস্করের তৈরি, এবং প্রাক্তন সোভিয়েত সরকারের উপহার দেওয়া রবীন্দ্রনাথের বিশাল আবক্ষমূর্তিতে মালা দেন, এতে মইয়ে চড়ে তাঁকে মূর্তিটির ভিত পর্যন্ত উঠতে হয়।

কিন্তু প্রয়াণকক্ষে গিয়ে উপাচার্য মালা দেওয়ার আগেই দেখা যায়, জোড়াসাঁকোর বাড়ির সদর দরজা থেকে চিতপুরের রাস্তা হয়ে বিবেকানন্দ রোড পর্যন্ত বিশাল এক জনতার সারি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণকক্ষে গিয়ে ফুল বা মালা দেবে বলে। তারা আসে কলকাতার সমস্ত প্রান্ত থেকে। তরুণী মা এসেছেন তিন বা চার বছরের সন্তানের হাত ধরে, সকালে স্নান করে শুচিস্নিগ্ধ হয়ে, দুজনেরই হাতে রজনীগন্ধার গুচ্ছ। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসেছেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এসেছেন একই রকম শুদ্ধ হয়ে, হাতে রজনীগন্ধার গুচ্ছ বা জুঁইয়ের মালা। এমন হতেই পারে, ব্যক্তিগত স্মৃতিও সেইরকম সাক্ষ্য দেয়, নবীন প্রেমিক-প্রেমিকারা এসেছে তাদের প্রেমে এক কবির অদৃশ্য আশীর্বাদ ছুঁইয়ে নেবার জন্যে, এসেছেন অজস্র মানুষ, সকলেই স্নানস্নিগ্ধ, সকলেই পুষ্পহস্ত, সকলেই শান্তভাবে অপেক্ষা করছেন কখন তাঁরা ওই মহৎ পরিসরে গিয়ে পৌঁছাবেন, তাদের হাতের ফুল অর্পণ করবে কবির স্মৃতিতে, ওই ঘরটির মেঝেতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করবে। কলকাতা শহরতলি থেকে জোড়াসাঁকো আসার সময়েই দেখেছি, লালপাড় শাড়ি পরা, হাতে রজনীগন্ধা বা জুঁইয়ের সঞ্চয় নিয়ে মেয়েরা, সাদা পাঞ্জাবি ধুতি বা পাজামা পরা ছেলেরা অপেক্ষা করছে প্রতিটি বাসস্টপে।  সকলেই জোড়াসাঁকোতে আসবে।  আজ যেন কলকাতার সমস্ত রাস্তা জোড়াসাঁকের দিকে বেঁকে গিয়েছে। কখনও বিদেশি দূতাবাস থেকে আসেন ফুল দিতে, আরও কত প্রতিষ্ঠানের অঞ্জলি এসে পৌঁছায়।

ঠাকুরবাড়ির সিংহদুয়ার খুলল, তাঁরা সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে একে একে দোতলায় পৌঁছালেন, বারান্দায় প্রয়াণকক্ষে গিয়ে পুষ্প অর্পণ করলেন, রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রছাত্রীরা সেগুলি গুছিয়ে সাজিয়ে রাখলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শহিদ মিনারে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ফুলের চালিগুলিকে সাজিয়ে রাখে। সারাদিন চলবে এই অনন্ত শোভাযাত্রা। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অন্য ঘরগুলিও খোলা এ দিনে। তাঁর শয়নকক্ষ, খাবার ঘর, রান্নাঘর, বিচিত্রা প্রদর্শশালা, তেতলায় কাদম্বরী দেবীর ঘর, তিনটি চিত্রশালা (বেঙ্গল স্কুল, রবীন্দ্রনাথ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্য শিল্পীদের)—মানুষ সব ঘুরে ঘুরে দেখবেন।  আমার সময়ে (১৯৯৬ নাগাদ, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাজের সূত্রে) রবীন্দ্রনাথের জন্মঘরটিও আবিষ্কার করা গিয়েছিল, সেটিও এখন অবশ্য দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মূল অনুষ্ঠান পাঠ, আবৃত্তি আর গানের।  প্রথমে মঞ্চের বাইরে রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রছাত্রীরা বহুর কণ্ঠে ‘হে নূতন’ গানটি গায়, পরে অন্য কোনও উদ্বোধনী গানের সঙ্গে একটু নাচও যোগ হয়েছে- তারপর উপাচার্যের পাঠ দিয়ে মঞ্চের উপরে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। একের পর এক আসতে থাকেন দেশের সব প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, আবৃত্তিকার।  সকলে এই দিনটিতে এই অঙ্গনে আমন্ত্রণ পাবেন বলে আশা করে থাকেন, না পেলে বঞ্চিত বোধ করেন। তাঁদের পরিবেশনার বাণিজ্যিক মূল্য বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে না, যা নামমাত্র হাতে দেয় তাতেই তাঁরা খুশি। রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে তাঁর জন্মদিনে অনুষ্ঠান করছেন, এতেই তাঁরা কৃতার্থ বোধ করেন, কোনও কারণে কেউ আমন্ত্রিত না হলে বঞ্চিত ও দুঃখিত বোধ করেন।  প্রত্যেকের একটি করে গান, একটি করে পাঠ। সবই পূর্বপরিকল্পিত, নির্দিষ্ট। কিন্তু কোথায় যেন একটা ইন্দ্রজাল ঘটে যায়, সকালের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যটি যেন এখানে তাঁরা দান করেন। হাততালি এখানে নিষিদ্ধ, এমনিতেই শ্রোতাদের কাছে তা নিরর্থক হয়ে যায়।

 যৌবনকালে গিয়ে দেখেছি, দেবব্রত বিশ্বাস গাইছেন ‘তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে’-তাঁর চোখে জল, আর তাঁর সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটস্বরে গাইছেন বিশ্বভারতীর তখনকার উপাচার্য সুধীরঞ্জন দাস, তাঁরও চোখে জল। সুচিত্রা মিত্র চোখে জল নিয়ে গাইছেন ‘ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব’, শান্তিদেব ঘোষ ধরেছেন ‘আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ সংসারকাজে’-তখন মনে হয়েছে ওই সকালবেলায় সমস্ত বাঙালির মনের কথাটি তাঁর গানে উচ্চারিত হল।

কালক্রমে এ ধরনের রবীন্দ্র জন্মদিন অনুষ্ঠান কলকাতার আর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তার বৈচিত্র্যই বা কত! ট্রেনের কামরায় নিত্যযাত্রীরা আয়োজন করেন রবীন্দ্র জন্মোৎসবের, গঙ্গাবক্ষে নৌকার উপর হয় রবীন্দ্র জন্মদিন, ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের নাটকের চরিত্র সাজিয়ে, এমনকি কাউকে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে, কেউ নিয়ে আসেন জোড়াসাঁকো বা রবীন্দ্র সদনে, ট্রাকের উপরে গানের দল রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে অঞ্চল পরিক্রমা করে, বাসের মধ্যে চলে রবীন্দ্র জয়ন্তী- সে এক কাণ্ডই বটে! কলকাতা দূরদর্শন সবই ধরবার চেষ্টা করে, ছিন্নবিচ্ছিন্নভাবে।

এই সময় কত যে পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যা বেরোয় তার সীমা নেই।  লিটল ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে তরুণরা তা মানুষের সামনে দোলাতে থাকে কেনার জন্য, কেউ রবীন্দ্র সদন চত্বরে মাটিতে চাটাই পেতে পসরা সাজিয়ে বসে যায়। জোড়াসাঁকোতে আর রবীন্দ্র সদনে মেলার মতো আরও কত পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা রবীন্দ্রনাথের ছবি, কাঁচা দাগের মাটি বা পোর্সেলিনের মূর্তি, বাঁশের আধখানা খণ্ডের গায়ে রবীন্দ্রনাথ, সরু কাঠির মাদুরের উপর রবীন্দ্রনাথ, চায়ের কাপে  রবীন্দ্রনাথ, হারের লকেটে রবীন্দ্রনাথ, ফুলদানিতে আঁকা রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর জন্মদিন এক অর্থে আমাদের নিজেদেরই জন্মদিন। তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের মহৎ অংশ, কখনও তাঁর সংগত বা অসংগত অহংকারের উৎস। তাঁর জন্মদিনে বাঙালি, যে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জন্ম নেওয়ার অভাবনীয় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, নিজেকে আরও বেশি করে পাওয়ার সাধনা করে। তাই তাঁকে নিয়েই হয়তো গড়ে উঠেছে বাঙালির আর এক ধর্মমুক্ত উৎসব।

(লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

digging-ponds-to-prevent-water-problems-in-nagarakata

Nagrakata | জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের নয়া কৌশল, জলকষ্ট ঠেকাতে পুকুর খনন নাগরাকাটায়

0
শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: পানীয় জলসংকট মোকাবিলায় এবার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের নয়া কৌশল পুকুর(Pond) খনন। জলাশয় তৈরি করে সেই জল পরিষ্কার করে তা পাম্পের সাহায্যে...

Aishwarya Rai Bachchan | হাতে প্লাস্টার নিয়েই নজর কেড়েছেন, দেশে ফিরতেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এবছর ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের (Cannes Film Festival) দিন কয়েক আগেই ডান হাতে চোট পান ঐশ্বর্য রাই বচ্চন (Aishwarya Rai...

Balurghat | আত্রেয়ীতে তলিয়ে গিয়েছিল দুই বোন, টোটোচালকের তৎপরতায় বাঁচল প্রাণ

0
বালুরঘাট: আত্রেয়ী নদীতে (Atrayee River) স্নান করতে নেমে তলিয়ে গিয়েছিল দুই বোন। অবশেষে এক টোটোচালকের তৎপরতায় প্রাণে বাঁচল দুই যুবতী। ঘটনাটি বালুরঘাট (Balurghat) শহরের...

Knife attack | পুঞ্চে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমাবেশে ছুরি নিয়ে হামলা, আহত তিন

0
পুঞ্চ: ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমাবেশ চলাকালীন ছুরি নিয়ে হামলা চালাল অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীরা। রবিবার জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় ঘটনাটি ঘটেছে। এতে তিনজন আহত হয়েছেন।...

Attempt Murder | চা বাগান মালিককে গুলি করে হত্যার চেষ্টা, দুষ্কৃতীদের খোঁজে তল্লাশি শুরু...

0
কিশনগঞ্জঃ চা বাগানের এক মালিককে গুলি করে মারার চেষ্টা করল তিন দুষ্কৃতী। রবিবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে কিশনগঞ্জের পাহাড়কাট্টা থানা এলাকায়। এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে...

Most Popular