- সুমন ভট্টাচার্য
‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গ্যায়ি পাপীও কে পাপ ধোতে ধোতে’।
রাজ কাপুরের এই বিখ্যাত ছবি, যা মন্দাকিনীর স্নান দৃশ্যের জন্য বেশি বিখ্যাত ছিল, সেখানে রবীন্দ্র জৈনের সুরারোপিত গানটির কথা মনে পড়ে গেল সন্দেশখালির ‘স্টিং ভিডিও’ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার হতে শুরু হওয়ার পর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যাঁকে তাঁর ভক্তকুল ‘মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম’-এর সঙ্গে তুলনা করে, তাঁরই দলের ‘গঙ্গা’ধর কয়ালের স্টিংয়ে ধরা পড়া বিভিন্ন কথা আসলে কি ‘পাপ ধোয়া’র সমতুল?
বিজেপির তরফে এবং বর্তমানে রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখ শুভেন্দু অধিকারীর পক্ষে যদিও সন্দেশখালির ‘স্টিং ভিডিও’কে ভুয়ো বলে দাবি করা হয়েছে, কিন্তু উত্তরবঙ্গ ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গে ভোট ঢোকার মুখে কি গেরুয়া শিবিরকে একটু নড়বড়ে করে দিয়ে গেল? তাৎপর্যপূর্ণভাবে যে ঘটনাকে শুভেন্দু রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল নেতৃত্বের জন্য ‘বোমা বিস্ফোরণ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, সেই হাইকোর্টে প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলও তো সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে দিল। নিজের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত দক্ষিণবঙ্গে তাই ভোটপর্ব যখন শুরু হতে চলেছে, তখন কি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে?
বাংলায় একটা পুরোনো প্রবাদ আছে, ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’। সন্দেশখালি নিয়ে তুমুল চাপানউতোর এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বেঁচে যাওয়া কোন ‘ফকির’-এর টিআরপি বাড়াবে তা অবশ্য বলা মুশকিল। যে বামপন্থীরা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন, তাঁদের অর্থাৎ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিমের ভাগ্য পরীক্ষা অবশ্য তৃতীয় দফার ভোটেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সিপিএমের অন্য প্রার্থীরা কি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা বামপন্থী আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে কোথাও প্রচারে নিয়ে যেতে চাইবেন? কারণ তৃণমূল ইতিমধ্যে বিকাশ অ্যান্ড কোংকে ‘চাকরিখেকো’ বলে রাজনৈতিক আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে। হাইকোর্টে সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদকে চাকরিহারাদের বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যেমন কুণাল ঘোষ তৃণমূলের তারকা প্রচারকের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছেন, তেমনই বিকাশ ভট্টাচার্যও কি বামপন্থীদের জন্য খুব আকর্ষণীয় প্রচারক হবেন?
সন্দেশখালি এবং শিক্ষক নিয়োগ। গত এক বছর ধরে রাজ্য রাজনীতির এই দুটিই প্রধান চুম্বক ছিল। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের শাসকদল বারবার বিদ্ধ হয়েছে, তাদের মন্ত্রী, বিধায়ক এমনকি শিক্ষার প্রশাসকরাও জেলে গিয়েছেন। ইডি-সিবিআই বাড়ির বাথরুমের ট্যাংক থেকে পানাপুকুর, কোনও কিছুই তল্লাশির বাইরে রাখেনি। এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার টেলিভিশনের কল্যাণে বাঙালির চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই বছরের গোড়া থেকে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়কে পিছনে ফেলে শিরোনামে চলে আসে সন্দেশখালি।
প্রথমে শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালাতে গিয়ে ইডির আক্রান্ত হওয়া এবং এক মাসের ব্যবধানে সন্দেশখালির মহিলাদের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখানো হেডলাইন দখল করে নেয়। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত, স্তম্ভিত করে দিয়েছিল যখন সন্দেশখালির মহিলারা ক্যামেরার সামনে এসে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করেছিলেন। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের জন্য যেমনই তা বিব্রতকর ছিল, তেমনই বিজেপি সন্দেশখালিকে জাতীয় ইস্যু করে তুলতে পেরেছিল। সর্বভারতীয় সব চ্যানেলের প্রাইম টাইমে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে কাটাছেঁড়া হয়েছিল সন্দেশখালিতে যৌন নিগ্রহের অভিযোগকে কেন্দ্র করে।
শাহজাহান বনাম সন্দেশখালির মহিলারা, বিজেপির এই ন্যারেটিভে যেমন মেরুকরণের তীব্র প্রয়াস ছিল, তেমনই মমতার শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা মহিলা ভোটকে ছিনিয়ে নেওয়ার কৌশলী প্রয়াসও লক্ষণীয় ছিল। বিজেপি এবং আরএসএসের তাত্ত্বিকরা জানতেন, এই বঙ্গের মহিলা ভোটে তৃণমূল নেত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও তপশিলি এবং আদিবাসী মহিলারা ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মফুলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। তাই সেই প্রবণতাকে হাওয়া দিতে এবং গোটা ভারতবর্ষে তপশিলি এবং আদিবাসী ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে সন্দেশখালি গেরুয়া শিবিরের প্রধান অস্ত্র ছিল। সন্দেশখালির রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড তাদের ঘরে উঠছেই, এটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ‘পোস্টার বয়’ শুভেন্দু অধিকারী আরও একটু আত্মবিশ্বাসী হয়ে তৃণমূল সরকারের উপরে ‘বোমা ফাটবে’ বলে ভবিষ্যদ্বাবাণী করে দিয়েছিলেন। এবং রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার দাবি অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্ট এক ধাক্কায় ২৬০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করে দিয়েছিল।
কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে ভোট ঢোকার মুখে সন্দেশখালি এবং শিক্ষক নিয়োগ, দুটি বিষয়েই প্রতিস্পর্ধী ন্যারেটিভ সামনে চলে এসেছে। সন্দেশখালির ক্ষেত্রে যদি স্টিং ভিডিও ভোটারদের বিপরীত ভাবনার দিকে ঠেলে দিতে পারে, তাহলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়। মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ আসার পর থেকেই রাজ্যের শাসকদল জোর গলায় বলতে শুরু করেছে, অযোগ্যদের সঙ্গে যোগ্যদের চাকরি বাতিল হবে কেন? যাঁরা এই গোটা প্যানেলই বাতিল করে দেওয়ার জন্য সওয়াল করেছিলেন, অর্থাৎ বিকাশ এবং তাঁর সহযোগীরা, তাঁদের তৃণমূল কাঠগড়ায় তুলছে। এবং যে দেশে, অর্থাৎ আমাদের ভারতবর্ষে কর্মসংস্থান সর্বদাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং হাল আমলের বিভিন্ন সমীক্ষাও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, গেরুয়া শিবিরের রাম মন্দির নিয়ে প্রচারকে পিছনে ঠেলে চাকরির সুযোগ বা কর্মসংস্থানের অভাবই ভোটারদের বেশি বিচলিত করছে, সেখানে কয়েক হাজার ‘যোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষকর্মীর চাকরি হারানো অবশ্যই রাজনীতির ভাগ্যনির্ধারক হতে পারে। তাই বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণা আসার পর অতিরিক্ত উত্তেজনায় যেমন রাজ্যের অনেক মিডিয়া, ‘সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিল না’ বলে খবর ছেড়ে দিয়েছিল, তেমনই শেষপর্যন্ত ধৈর্যের পরীক্ষায় জিতে মমতা জানেন সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনিই আপাতত ‘অ্যাডভান্টেজ’-এ।
তাহলে বিজেপির কী হবে? সন্দেশখালি কি তাদের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলতে দেবে? না গেরুয়া শিবিরে এতদিন ধরে তৈরি করা অস্ত্রে, অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় পালটা প্রচার দিয়ে তৃণমূল নিজেদের রাজনৈতিক জমি ধরে রাখতে পারবে? দক্ষিণবঙ্গে ভোটপর্ব শুরু হওয়ার আগে আপাতত যাবতীয় রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। আর মমতা প্রায় ২০২১-এর রাজনৈতিক কৌশলে ফেরত গিয়ে বিজেপিকে ‘বাংলা বিরোধী’ বলে দেগে দিয়ে রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখতে চাইছেন। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের ‘নম্বর ২’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটি জনসভায় প্রচারে যে বিষয়টিকে সামনে আনতে চাইছেন, সন্দেশখালির ‘স্টিং ভিডিও’ কিংবা নরেন্দ্র মোদির আমিষ খাবার নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষের বিষয়টিকে তুলে ধরে যে, গেরুয়া শিবির বা বিজেপি বাঙালির মন বোঝে না। তাই বিজেপি ‘বাংলা বিরোধী’। ঠিক যেরকম একসময় ‘মারাঠি অস্মিতা’ মহারাষ্ট্রের ভোটচুম্বক ছিল, তেমনই বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল ‘বাঙালি স্বাভিমান’কে অস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। এবং দক্ষিণবঙ্গে ভোটপর্ব শুরু হওয়ার আগে মমতা থেকে মহুয়া মৈত্র সেই অস্ত্রেই বাজিমাত করতে চাইছেন।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে শীতলকুচি নির্ণায়ক ঘটনা ছিল। ২০২৪-এ গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা ভোটে শেষ চার দফাতে কি সন্দেশখালি এবং সুপ্রিম কোর্টে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বহাল রাখার সিদ্ধান্তই নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারে?
(লেখক সাংবাদিক)