সৌমিত্র দস্তিদার
বাংলাদেশে তো কম দিন যাচ্ছি না। যখনই যাই, চেষ্টা করি, সেখানকার সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। এই যেমন কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অজস্র খ্যাত অখ্যাত জনপদে ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে চেষ্টা করছি, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে তাদের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথাব্যথা কতটা। তার মধ্যেই সিএএ ঘোষণা করে দেওয়া হল নয়াদিল্লিতে। মঙ্গলবার, বুধবার-পরপর দু’দিন বাংলাদেশে ঘুরতে ঘুরতে তার আঁচ পাওয়া যায় না। কিন্তু কোথাও অন্য একটা তীব্র সংশয় লুকিয়ে থাকে। একরকম দোদুল্যমানতা।
আসলে এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ঠিকঠাক সংখ্যা কতটা সেটাও খুব পরিষ্কার নয়। সরকারি হিসেবে দশ শতাংশের কাছাকাছি। এই জনগোষ্ঠী কিন্তু একমাত্রিক নয়। এখানেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নানা ভাগে ভাগ হয়ে থাকেন। ডোম, মুচি, মেথরদের মতো দলিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে উচ্চ বর্গের বিভাজন আজও যথেষ্ট। দেশের দক্ষিণের ছবি আর উত্তরের পরিস্থিতি আবার আলাদা। উত্তরে জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ি দক্ষিণের চেয়ে বেশি। পঞ্চগড় হয়ে ঠাকুরগাঁও, দেবীগঞ্জ, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম কিংবা নাটোর, পাবনা সব জায়গাতেই শহরে গ্রামে হিন্দু লোকসংখ্যা খুব কম নয়। পঞ্চগড়ে যদি দশ শতাংশ হয়, ঠাকুরগাঁওয়ে, একদা চারু মজুমদারের রাজনীতির সূতিকাগার বোদা অঞ্চলে এখনও হিন্দু মানুষের সংখ্যা চল্লিশ শতাংশের ওপরে। আবার যশোরের ছিয়ানব্বই গ্রাম বা খুলনা বরিশালের অনেক অনেক জায়গায় এপারের সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি বেশ ভালো।
ঘটনাচক্রে ক্যা বা সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট যেদিন ঘোষিত হল, আমি সেদিন বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলা কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত চিলমারী এলাকায় ঘুরছিলাম। আব্বাসউদ্দিনের গানের দৌলতে চিলমারী বন্দরের নাম অনেকেই জানেন। চিলমারীতে সেদিন হাট বসেছে। সামনে ব্রক্ষ্মপুত্র। কোথাও জল থাকলেও, বেশিরভাগ জায়গাতেই ধু-ধু বালির চর। লোকে হেঁটে পার হচ্ছে। কাছেই রৌমারী, সেখান থেকে নামাজের চর হয়ে আসামে যাওয়া যায়।
নদী পাড় দিয়ে হাঁটছি। আশপাশে জেলে বস্তি। বস্তি না বলে গ্রাম বলাই ভালো। অধিকাংশ মানুষজন নিত্যানন্দ সম্প্রদায়ের। মাঝেমাঝেই কীর্তনের আসর বসে। মন্দিরে পুজোপাঠ নিত্যদিনের ব্যাপার। গ্রামের লোকজন আদর করে ঘরে ডাকলেন। সময় কম। যেতে হবে। তবুও তার মধ্যে সুখদুঃখের নানা বৃত্তান্ত। কারও জমিজিরেত নেই। মাছ ধরে মোটামুটি জীবন কেটে যায়। ভারতের কোথায় কী এক ক্যা এসেছে তা নিয়ে আদৌ কোনও মাথাব্যথা এখানকার কারও নেই।
বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিন্তু এই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কৌতূহল থাকলেও আগ্রহ নেই। দিনাজপুরের ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দিরের অনেক এলাকাতেই কথা বলে দেখলাম, নতুন করে ভারতে গিয়ে সেখানে স্থায়ী বাসিন্দা হবার কথা কেউই ভাবছেন না। তবে সেটাই সব নয়। এর মধ্যে মোচড় রয়েছে। অনেকেই কানাঘুষোয় যেটুকু যা শুনেছেন, তাতে নতুন এই আইনে যেভাবে আগেই তাঁদের ফর্ম ফিলআপ করে নিজেদের বিদেশি জানিয়ে দিতে হবে বলা হয়েছে তাতে ভারতের হিন্দুদের নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বরিশালের অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। তাদের চিন্তা এই আইনের ফলে বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। ভোলার বাসিন্দা আমার আর এক বাসিন্দা বলছিলেন, এসব ফালতু স্বপ্ন দেখিয়ে নতুনভাবে বিভাজনের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। এ পুরোপুরি ভোটের কৌশল।
পাশাপাশি আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখছি বলে বুঝতে পারি, যে একটা স্রোত কিন্তু কিছু হিন্দুর মধ্যে অবচেতনে ঘুরছে, হয়তো নরেন্দ্র মোদির ভরসায় পশ্চিমবঙ্গে বা অসমে গেলে ভালো হবে। আসলে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক হিন্দুর মধ্যে ইদানীং অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সে তাদের অনেকের সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি দেখলেই বোঝা যায়। এর পিছনে নিঃসন্দেহে ভারতের শাসকদের অনুগত সমর্থকদের মদত আছে। এটাই সাধারণ হিন্দুদের ভয়ের কারণ। আশঙ্কা, এর পরিণাম ভালো হবে না। নতুনভাবে ফের অশান্তি হলে ভারত মোটেও আদর করে কাছে টেনে নেবে না। ভোটের আগের প্রতিশ্রুতি আর জিতে গেলে তা পালন করা যে এক নয় তা বাংলাদেশের হিন্দুদের অজানা নয়।
ভারতে নির্দিষ্ট কোনও একটি সম্প্রদায়ের ওপর চাপ বাড়লে, এখানেও পালটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এই কথাটা আমাদের শাসকেরা ভুলে যান। তার ওপর হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির নিরন্তর মিথ্যে, অর্ধসত্য প্রোপাগান্ডা। যা গোয়েবলসীয় যুগকে মনে পড়িয়ে দেয়। ভারতে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে যা শোনা যায়, তার সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মিল নেই। জটিলতা নেই, অশান্তি, বিদ্বেষ নেই বলব না। তবে যে অন্ধকারের ছবি আঁকা হয় তা পুরোপুরি ঠিক নয়।
বরিশালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলেজের এক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে যে অনেকেই মনে করেন যে ওপারে সর্বসুখ। ফলে কোনওরকমে জমিজায়গা বেচে দিয়ে চলে গেলেই কেল্লা ফতে। অথচ অনেকেই পরবর্তী সময়ে দুঃখ করেছেন, কেন গেলাম। আমার চেনা সিরাজগঞ্জের এক ভদ্রলোক বলছিলেন, মৃত্যুভয়ে এপারে এলাম। বাংলাদেশের অলিগলি এখনও চোখের সামনে ভাসে। আর এখন দমদমে থাকি। নিঃসঙ্গ। একা। কেউ চেনে না। একে কি বেঁচে থাকা বলে!’
সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাবে কথা হচ্ছিল বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে। একজন সটান বলে দিলেন, ‘নাগরিকত্ব কেন, গাড়ি বাড়ি দিলেও ভারতে যাব না। বেশ আছি এখানে।’ দেশভাগ অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা শুধু একটি সম্প্রদায়ের নয়। উভয় সম্প্রদায়ের। শিলিগুড়ি, কলকাতায় যেমন শুনবেন, কেউ খুলনা, রাজশাহি, ফরিদপুর, পাবনা, রংপুর থেকে চলে এসেছিলেন এপারে। তেমনি দিনাজপুর, গাইবান্ধা বা রাজশাহিতে শুনবেন, কারও পুর্বপুরুষ বাধ্য হয়ে চলে এসেছিলেন অসম, পশ্চিমবঙ্গের কোনও না কোনও জেলা থেকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু, অন্তত আমার যাঁদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে, তাঁদের আশঙ্কা, এই আইন নতুন করে ফের একবার দেশভাগের যন্ত্রণার স্মৃতি খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে।
বলছিলাম না যে, দেশভাগ কেড়েছে নিশ্চিত অনেক কিছু। তবে মনুষ্যত্ব কোনও দিকেই পুরোপুরি আজও নষ্ট হয়ে যায়নি। ফলে বাংলাদেশের জনপদ মৌলবাদীদের দখলে চলে গিয়েছে, আমি অন্তত তা বিশ্বাস করি না। আবার গ্রাম এলাকায় একধরনের নিরাপত্তাহীনতা হিন্দুদের নেই সেটাও বলব না। বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে কিছু কিছু ঘটনায় ঈষৎ বিভ্রান্ত হিন্দু জনগোষ্ঠী দ্বিধায় ভোগে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে। সেক্ষেত্রে ভারতের দিকে কেউ কেউ পা বাড়িয়ে থাকেন। অনেকে আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ অসমে জমি বাড়ি করে ইতিমধ্যেই সেখানে আত্মীয়স্বজনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, এরকম উদাহরণ যথেষ্ট। বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে নানা ভাগ, নানা মাত্রা। হিন্দু জনসংখ্যা কমার পিছনে শুধুই ধর্মীয় নির্যাতন, এই বিশ্লেষণ কিন্তু ঠিক নয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বহু কারণ আছে। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, এখানকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বাংলাদেশেকেই তাঁর দেশ মনে করেন। এমনিতে ক্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওই যে সংশয়, আর দোদুল্যমানতা- সেটা কিন্তু থেকেই গিয়েছে।
(লেখক তথ্যচিত্র পরিচালক)