সৃজা কবিরাজ
আজকের পৃথিবীতে সম্পদে, বৈভবে, স্বাচ্ছন্দ্যবোধে বাইরে থেকে সবকিছুই ঝলমলে! কিন্তু প্রদীপের তলার অন্ধকারটাও এখন বেশ গাঢ়। মায়াবী জগতের হাতছানিতে মানুষের মানসিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সহজ সরল সম্পর্কের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত কালনাগিনী। বদল হয়েছে সম্পর্কের সংজ্ঞা। সম্পর্ক এখন বিক্রি হচ্ছে।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও ভাবিয়েছিল এই সম্পর্কের বাজার। সেখানে ‘সম্পর্ক বিক্রি হচ্ছিল খোলা বাজারে’। বাবা-মা, ভাই-বোন, মানবিকতা, বিশ্বাসের সম্পর্ক। কবি বহুদিন আগেই এই কেনাবেচার কথা বললেও ইদানীং সাধারণ মানুষ এই বিপণনের শিক্ষা পাচ্ছে হাড়েহাড়ে। চাওয়াপাওয়ার নেশায় ঘর ভাঙছে। এমনকি কাজের দুনিয়াটাও কাঁপিয়ে দিয়েছে অদ্ভুত, অনাচারী মুখোশধারী নকল সম্পর্ক। বিশেষত যুবসমাজে এর প্রভাব বহুদূর। তাই দিশেহারা তরুণ-তরুণী অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। কেউ বা আবার সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে অতীতের মধুর সম্পর্কগুলোর অপমৃত্যু ঘটিয়ে ভয়ংকর নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। হারিয়ে ফেলছে ন্যায়-অন্যায় বিচারবোধ।
নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা আজকাল মায়া, মমতা, শ্রদ্ধাকে ভুলিয়ে দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে খবরের কাগজের পাতায়, নেট দুনিয়ায়। একদিকে সন্তানের অন্যায় আবদারে বাবা-মা নির্যাতিত, নিহত কিংবা রক্তাক্ত। জমি বেচে বাইক চাই। মায়ের গয়না বেচে শখের মোবাইল। অন্যদিকে সাত বছরের শিশুসন্তানকে খুন করে ব্যাগে ভরে নিয়ে যাচ্ছে মা। ঝকঝকে তরুণের দুটো-তিনটে সংসার। তরুণী বধূ বিদেশে পাচার হচ্ছে প্রেমিকের ভালোবাসায়। আর তার থেকেও ঘৃণ্য- বিশ্বাসের সত্যনাশ করে নিষ্পাপ কিশোরীকে পাড়ার কাকু বাইকে করে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে কাটাছেঁড়া করতে। এরপর থাকছে খুন, জখম, পুড়িয়ে মারা, ঘর ভাঙার মতো কিছু কু-সন্তান, আত্মীয়, পড়শির লীলাখেলা।
কিন্তু এই সাদা চোখের সাধারণ পাপের সিঁড়ি অনেক ওপরে উঠেছে বহির্জগতের অন্দরমহলে। সেখানে আছে ছিপছিপে, কর্মনিপুণ, ঝকঝকে কিছু তরুণ-তরুণী। কাজের দুনিয়া তাদের মূল্যবোধগুলোকে বইয়ে দিয়েছে ভিন্ন খাতে। সম্পর্ক সেখানে রাজত্ব করছে লিভিং রিলেশনে, হুক-আপ কালচারে, ওপেন ম্যারেজে। অন্যদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার কোনও কোনও জায়গায় ঝলমলে আলোর নীচে ঘন অন্ধকারে সম্পর্ক বসে রয়েছে উঁচু সিংহাসনে সুগার ড্যাডি, সুগার মম রূপ নিয়ে। রোবটের মতো সুগার বেবিদের তারা হিরণ্যকশিপু কিংবা ব্রহ্মদৈত্যর মতো খপ করে মুখে পুরে ফেলতে পারে। তখন তরুণ-তরুণীদের কাজের সময় আট থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা!
কোথাও আবার ‘টার্গেট’ নামক একটি শব্দের ফাঁদে পড়ে আতঙ্কে কাটাতে হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের। এই টার্গেট পূরণ, প্রোজেক্টের ব্যর্থতার সঙ্গে সম্পর্কের জোট বাঁধা আছে কর্তৃপক্ষের মন জোগানোর। নতুবা অযোগ্যতার দোহাই, সর্বোপরি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সব মিলিয়ে চাকরি সেথায় পদ্মপাতার জল! অতএব আত্মহত্যা, নিখোঁজ, প্রতারণার ফাঁদে পড়া, বিপথগামী তরুণ-তরুণীদের খবরের শিরোনামে উঠে আসতে বাধা কোথায়! সম্পর্কের বাঁধন আলগা হওয়ায় পরিবারের মানুষজন জানতেও পারেন না তাদের অজানা দেশে পাড়ি দেওয়ার কারণ। তবুও জীবন চলছে। সুস্থ সম্পর্কের পরিবেশ আর মানবিকতাবোধ শীতঘুম ছেড়ে জেগে উঠলে হয়তো এখনও রক্ষা পেতে পারে কিছু বিপন্ন প্রাণ।
(লেখক শিলিগুড়ির মেয়ে, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা)